• ২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ১৫ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ৩০শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

মন্ত্রীর ছেলে-ভাই ও ভাগনেও যেন মন্ত্রী, সবকিছু হয় তাদের কথায়

sylhetsurma.com
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৩
মন্ত্রীর ছেলে-ভাই ও ভাগনেও যেন মন্ত্রী, সবকিছু হয় তাদের কথায়

মামুনুর রশিদ, জুড়ি (মৌলভীবাজার) থেকে::
সামনে পুলিশ প্রটোকলের গাড়ি। চারপাশে মোটরসাইকেলের বহর। সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলছে কালো রঙের একটি প্রাইভেটকার। হরহামেশাই এমন দৃশ্যের সাক্ষী হন মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার মানুষ। ওই গাড়িতে থাকা ব্যক্তিটির নাম জাকির হোসেন জুমন। তিনি নিজে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন। তবে তার বাবা পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। বাবার ক্ষমতার বদৌলতে নিজেও পুলিশ প্রটোকল নিয়ে ঘুরে বেড়ান এলাকায়। সঙ্গে থাকে গানম্যান। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি মূর্তিমান আতঙ্ক। এমনকি মন্ত্রণালয় পরিচালনায়ও নেপথ্যে ভূমিকা রয়েছে তার। উৎকোচের বিনিময়ে ঠিকাদারি কাজ বরাদ্দ দেন।
শুধু ছেলে নন, মন্ত্রীর ভাই, ভাগনেসহ স্বজনরা লুটেপুটে খাচ্ছেন দুই উপজেলার সব। পাহাড়ের জায়গা দখল করে বাংলো নির্মাণ, বনের গাছ সাবাড় করে অবৈধ করাতকল, জনপ্রতিনিধি হওয়ার পরও নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে ঠিকাদারি কাজ, ইউপি নির্বাচনে টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন, মন্ত্রণালয়ে বদলি বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে মন্ত্রীর ছেলে এবং স্বজনদের বিরুদ্ধে। এমনকি মাদক এবং স্বর্ণ চোরাচালানকারীদের সহায়তা করার বিষয়টিও ওপেন সিক্রেট।
২০১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের প্যাডে লেখা এক চিঠিতে তার ছেলে ও মেয়ে জামাইয়ের চা বাগান করার জন্য ৯৯৮ দশমিক ৫৬ একর খাস জমি বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি। এতে বলা হয়, ‘আমার নিজ নির্বাচনী এলাকায় জেলা প্রশাসকের নামে থাকা খাস জমিতে নতুন চা বাগান সৃজনের জন্যে অত্যন্ত উপযোগী। মোট ৯৯৮ দশমিক ৫৬ একর ভূমিতে গ্রো গ্রিন বায়োটেক লিমিটেড কোম্পানি শাহজালাল টি গার্ডেন নামে একটি চা বাগান সৃজন করার লক্ষ্যে ইজারা নিতে আগ্রহী। ওই কোম্পানির উদ্যেক্তাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি এবং তাদের পরিবার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে অবদান রেখে আসছে।’
অথচ গ্রো গ্রিন বায়োটেক লিমিটেডের নথিপত্র বলছে, কোম্পানির শেয়ারের বড় একটি অংশের মালিকানায় রয়েছেন মন্ত্রীর ছেলে জাকির হোসেন জুমন এবং তার জামাই গোলাম রসুল রাহেল চৌধুরীর নামে।
পরিচয় গোপন রেখে নিজের পরিবারের সদস্যদের জন্য জমি বরাদ্দ চেয়ে এমন চিঠি লেখার উদাহরণ একেবারেই বিরল। উদ্যোক্তারা তার পরিচিত উল্লেখ করে তাদের পরিবারের অবদান সম্পর্কে যেভাবে প্রশংসা করা হয়েছে, তা অনৈতিক তো বটেই, প্রতারণার শামিল বলেও অনেকে মনে করেন।
জানা যায়, বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় দেনদরবার করলেও অনৈতিক বিবেচনায় জেলা প্রশাসন এবং ভূমি মন্ত্রণালয় জমিটি এখনো ইজারা দেয়নি। দেশের স্বর্ণ পাচারকারী চক্রের আলোচিত নাম সুলতান মিয়ার সঙ্গেও সখ্য রয়েছে পরিবারের। এই চক্রের চোরাচালানের ধরা পড়া স্বর্ণ ফেরতের জন্য মানিকগঞ্জ জেলার পুলিশ কর্মকর্তাদের টেলিফোন করেছিলেন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন, যা দেশজুড়ে আলোচিত হয়।
বড়লেখা আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর ভাষ্য, সুলতান মিয়ার সঙ্গে মন্ত্রীপুত্র এবং উপজেলা চেয়ারম্যান ভাগনের সখ্য বেশি। সেই সূত্রেই মন্ত্রীর সঙ্গে তার পরিচয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্ত্রীর সঙ্গে সুলতান মিয়া এবং তার ঘনষ্ঠিদের বেশ কিছু ছবিও রয়েছে।
শুধু মানিকগঞ্জের ঘটনাই নয়, মন্ত্রীর নিজ নির্বাচনী এলাকা জুড়ী উপজেলায়ও স্বর্ণ চোরাচালানি সুলতান মিয়ার নির্যাতনের শিকার হয়েছে একটি পরিবার। রাতের আধারে ওই পরিবারের বয়োবৃদ্ধ সদস্যদের মারধর এবং তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। আর এ কাজে সুলতানের সঙ্গে সহযোগিতা করে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরা।
এ বিষয়ে প্রবাসী জুয়েল মিয়া বলেন, ‘তাদের স্বর্ণ চোরাচালানে সহায়তা না করায় মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমার বৃদ্ধ বাবাকে মারধর করেছে। আমাকে দেশে ফিরতে দিচ্ছে না। উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা এই কাজ করছেন। যারা প্রভাবশালী।’
কেবল স্বর্ণ চোরাচালানি নয়, মাদক ব্যবসায়ীরাও ঘনিষ্ঠ মন্ত্রীপুত্রের। আর তাদের আশকারা পেয়ে এই দুই উপজেলায় দেদারসে ব্যবসা করছেন। সম্প্রতি বড়লেখা উপজেলার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী মিশন দাসকে বিপুল পরিমাণে ফেনসিডিলসহ আটক করে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে মন্ত্রীর বলয়ে প্রভাবশালী এই মিশন দাস। বিভিন্ন সভা-সমাবেশের ছবিতেও বিষয়টি স্পষ্ট বলে দাবি করেন অনেক নেতাকর্মী।
বড়লেখা উপজেলা চেয়ারম্যান শোয়েব আহমেদ বলেন, ‘আমি বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেছি। তবে কোনোরকম অপরাধের সঙ্গে জড়িত নই। প্রতিপক্ষ মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায়।’ নির্বাচনে জয়লাভের পেছনে মন্ত্রী মামার কোনো ভূমিকা ছিল না বলে তার দাবি।
এসব বিষয়ে জানতে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রীর পুত্র জাকির হোসেন জুমনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি।
তবে মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কারা এসব অভিযোগ করেছেন-তা জানতে চেয়ে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ আমরা পাইনি। সামনে নির্বাচন আসছে। এ রকম কত অভিযোগ আসবে। নির্বাচনের আগে প্রতিপক্ষ ইচ্ছে করে এসব ছড়ায়। আপনারা যাচাই-বাছাই করে বিষয়টি তুলে ধরবেন।’