বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের রেলপথ ব্যবহারের সমালোচনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এটা নিয়ে কেন সমালোচনা হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। ইউরোপে তো এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের কোনো বর্ডার নেই, তারা কি বিক্রি হয়ে গেছে? এতে বরং তাদের যোগাযোগ সুবিধা বেড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) বেলা ১১টার দিকে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা বলে দেশে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, তারা বলুক বিক্রিটা কিসের মাপে হচ্ছে? মাপটা কিসের মাধ্যমে হচ্ছে? বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ, আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি। সারাবিশ্বে একটিমাত্র মিত্র শক্তি ভারত, যারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে আমাদের স্বাধীন করে দিয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই কোন দেশ যুদ্ধে সহযোগিতা করতে এলে তারা সেখানেই থেকে যায়। বিজয়ী হওয়ার পরও তারা দেশ ছাড়ে না। এরকম অসংখ্য নজির আমরা দেখেছি। অথচ ভারত আমাদের মিত্র হিসেবে যুদ্ধ করেছে এবং জাতির পিতার আহ্বানে আবার তারা ফিরেও গেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তাহলে বাংলাদেশ কীভাবে বিক্রি হয়? আমি বলবো যারাই বলছে দেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, তারাই বরং দেশকে বিক্রি করতে চেয়েছে। আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রেখেছি। এখন যারা দেশ বিক্রির কথা বলে, তারাই মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের দালালি করেছে।
তিনি আরও বলেন, রেলপথ ব্যবহারের ফলে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ হচ্ছে। ওইসব এলাকার মানুষের জন্য যোগাযোগ সহজ হচ্ছে। ইউরোপে তো বর্ডারই নেই, তারা কি তাহলে বিক্রি হচ্ছে? প্রত্যেকটা দেশই তো স্বাধীন দেশ, তারা তো বিক্রি হয়নি। তাহলে সাউথ এশিয়ায় কেন এটা বাধা হয়ে থাকবে?
এ সফর ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত ফলপ্রসূ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নতুন সরকার গঠনের মাধ্যমে ঢাকা ও দিল্লি নতুনভাবে পথচলা শুরু করেছে। সে ধারাবাহিকতায় ‘রূপকল্প ২০৪১’ এর ‘স্মার্ট-বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করার ব্যাপারে আমরা আলোচনা করেছি। এ সফর ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত ফলপ্রসূ। আমি মনে করি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে এ সফর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে।
ভারতের সঙ্গে সীমান্তে হতাহতের ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ জুন দিল্লি পালাম বিমানবন্দরে আমাকে বর্ণাঢ্য অভ্যর্থনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়। ওই দিন সন্ধ্যায়, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস. জয়শঙ্কর আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়াও, ভারতের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের সম্ভাবনা ও পন্থা নিয়ে আলোচনা করে। এসময় আমার সফরসঙ্গী ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলও আলোচনায় অংশ নেয়।
নোবেল পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার নেই
শেখ হাসিনা বলেছেন, নোবেল প্রাইজের জন্য না কি আমি ড. ইউনূসকে হয়রানি করছি। আমার সঙ্গে আসলে কারো কোনো দ্বন্দ্ব নেই। জীবনেও আমার নোবেল প্রাইজের জন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। নোবেল প্রাইজ পেতে লবিস্ট রাখার মতো অত টাকা-পয়সাও নেই। আর আমি কখনো চাইনি।
ড. ইউনূসকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি করার পর অনেক বিদেশি, অনেক নোবেল বিজয়ী আমাকে নিয়ে লিখেছে। কই আমি তো তদবির করতে যাইনি। ওগুলো আমার মাথার মধ্যেও নেই। যিনি অর্থনীতি নিয়ে কাজ করলেন, ব্যাংকের একটা এমডি… সে যখন একটা নোবেল প্রাইজ পায়, সেজন্য আমি কনটেস্ট করতে যাবো কেন?
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি আমি করেছি। পৃথিবীতে যত শান্তিচুক্তি হয়েছে, কয়টা অস্ত্রধারী আত্মসমর্পন করেছে? এক হাজার ৮০০ জন অস্ত্রধারী আমার কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছে। আমি তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসন করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির কারণে আজকে সেখানে উন্নয়ন হয়েছে। চুক্তির আগে সেখানে কী অবস্থা ছিল? সেখানে কী আমরা কেউ যেতে পারতাম? ৬৪ হাজার শরণার্থী ছিল ভারতে। আমি তাদের ফিরিয়ে এনে প্রতিষ্ঠিত করেছি।
তিনি আরও বলেন, কেউ যদি এখন আমার নামে নোবেলের জন্য প্রস্তাব দেয়… আমরা তো যাইনি তাদের কাছে। আমার আসলে এসব পুরস্কারের দরকার নেই। এখানে আলাদা একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে, এখানে আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। আর বলে দিলো এটা নিয়ে আমার না কি জেলাসি!
সরকারপ্রধান বলেন, তিনি (ড. ইউনূস) তো রাজনৈতিক দল করতে চাইছিল, সেটিও লেখালেখি হয়েছে। ২০০৭ সালে দল করতে গিয়ে তিনি ব্যর্থ হলেন কেন? গ্রামের মানুষের জন্য যিনি এত কিছু দিয়ে থাকে, তিনি দল করতে পারলেন না কেন? তার দলে তো সেই মানুষগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। তারা সাড়া দেয়নি। কারণ তারা সুদের চাপে মৃতপ্রায় ছিল। সে দায় কী আমার? আর আমি তো তখন জেলে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমি বিদেশে… আমার বিরুদ্ধে খুনের মামলা দেওয়া হয়েছিল। আমি তো দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমাকে বলা হলো, ফিরতে দেওয়া হবে না। আমি তো ফিরেছি। আমার সঙ্গে তার কীসের তুলনা? যায় না।
তিনি বলেন, আমি তো কখনো কিছু বলিনি। একটা প্রশ্ন আমার, এই যে বিদেশে বিদেশে বিনিয়োগ, এটা কীভাবে হলো? টাকাটা কোত্থেকে আসলো, কাদের টাকা? সেই জবাবটা দিক। এটা সংবিধিবদ্ধ চাকরিতে থাকা অবস্থায় বিদেশে বিনিয়োগ, আইন কী বলে? আমরাই তো সবাই মিলে তাকে তুলেছি, এটা ঠিক। এখন না কি সব দোষ আমার। কারণ সব থেকে বেশি টাকা আমি দিলাম তার গ্রামীণ ব্যাংকে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার গ্রামীণ ব্যাংক দাঁড় করাতে টাকা দেওয়া, ১৯৯৭-৯৮ সালে বন্যা… গ্রামীণ ব্যাংক যায় যায় অবস্থা। ৪০০ কোটি টাকা দিয়েছি। সব থেকে বেশি যে করে, তার মূল্যায়ন এমন! আবার জেলাসি… জেলাসি করার কী আছে? সে আসুক না, মাঠে আসুক! চলুক আমার সঙ্গে। আসুক, কথা বলব। সব থেকে বেশি আর্থিক সুবিধা নিয়েছে আমার কাছ থেকেই।
শেখ হাসিনা বলেন, উনার পয়সা আছে, উনি লেখাচ্ছেন। উনি যদি এতই জনপ্রিয় হন, তাহলে বিজ্ঞাপন কেন? তার জন্য তো সারা বিশ্ব ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। একটা মামলা চলছে। সেটি নিয়ে তো আমি কথা বলতে যাই না।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জীবজন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাপ বরং মানুষকে ভয় পায়। ভয় বা আতঙ্ক থেকেই মানুষকে কামড় দিতে আসে। তাই সাপকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভয় করলে মানুষকেই করতে হয়, জীবজন্তু বা সাপকে নয়।
তিনি বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্যই জীবজন্তু। যেহেতু সাপের উপদ্রব বেড়েছে, এখন চলাফেরায় সতর্ক হতে হবে। আমি একটা বিষয়ে বিশ্বাস করি, জীবজন্তু-সাপ যাই বলেন, এরা কোনোদিন খামাখা কোনও মানুষকে আক্রমণ করে না, যদি না তারা ভীত হয়ে যায় বা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে থাকে। তাছাড়া তারা কোনোদিন কারও ক্ষতি করে না।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যখন মাছ ধরতে বসি, তখন দেখি পাশ দিয়েই সাপ যাচ্ছে। একদিন দেখি আমার বসার স্থানের পাশেই একটা সাপ মুখ বের করে আছে। কই, কোনোদিন আমাকে সাপে কাটেনি তো। কোনোদিন ভয়ও পাইনি।