• ২৬শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১১ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

মাদকের ব্যবসা করে কোটিপতি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পভাবশালী

sylhetsurma.com
প্রকাশিত মার্চ ১৭, ২০২২
মাদকের ব্যবসা করে কোটিপতি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পভাবশালী

মো: নাছির উদ্দীন, স্টাফ রিপোর্টার :
মাদকের আন্ডারওয়ার্ল্ডে তারা ডন হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ বলেন গডফাদার। তাদের হাতেই সিলেট জেলার মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। বলছিলাম উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মনসুর আহমেদ এর কথা। যার মদদে মাদক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার করিগর। আর তাদের মাদক সংশ্লিষ্ট সকল অপকর্মের সম্পাদনকারী হচ্ছেন গোলাপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি খয়রুল হক।

এক দশক আগেও অত্র এলাকায় মাদকের এমন সর্বগ্রাসী অবস্থা লক্ষ্য করা যায়নি। বিগত উপজেলা নির্বাচনের পরে পাল্টে যায় এই উপজেলার অধীনে ঢাকাদকিক্ষণ বাজার, পুরকায়স্ত বাজার, হেতিমগঞ্জ বাজার, চন্দরপুর, সীমান্ত উপজেলা জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার সহ সহ আশপাশের মাদকের চিত্রায়ন। আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে থাকে ইয়াবা, ক্রিস্টাল ম্যাথ, গাঁজা, কোকেন, ফেনসিডিল, ভারতীয় মদ ইত্যাদির ক্রয়-বিক্রয় এবং সেবন। সরেজমিন অনুসন্ধান করে মাদক সংশ্লিষ্টতার ভয়ংকর সব তথ্য উঠে আসে। বিভিন্ন সরকারদলীয় ও বিরোধীদলীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের নাম মানুষের আলোচনায় মুখে মুখে। বিভিন্ন সময় দুই-একজন মাদক কারবারী ধরা পড়লেও তারা কদিন পরই বের হয়ে যান। মূল হোতারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। অতি সম্প্রতি সিলেট সদর থানার আশেপাশে অভিযান পরিচালনা করে ৫১ কেজি গাঁজা এবং মাদক পরিবহনে ব্যবহৃত একটি প্রাইভেটকার’সহ সেলিম (৩৫) এবং সোহেল (২৭) নামে দুইজন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত মাদক ব্যবসায়ীরা অবৈধ মাদক তথা গাঁজা ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। কিন্তু মামলা দায়ের করার পূর্বেই প্রভাব খাটিয়ে থানা থেকে তাদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মনসুর আহমেদ। এই ঘটনার পর আমাদের সন্দেহের তীর তার উপর স্থির হয় এবং আমরা খুঁজতে থাকি মাদকের গডফাদারদের। ১ মাসের অধিক সময় অনুসন্ধান করে আমরা অধিকতর নিশ্চিত হয়ে প্রতিবেদন লিখি।

এই প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহ করতে যেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতবিরাতে ছদ্মবেশে আমি বিভিন্ন মাদকের আড্ডায় ঘুরে বেরিয়েছি। কাদের মাধ্যমে অত্র এলাকায় মাদকের প্রসার ঘটছে তা জানার জন্য আমরা কৌশলে বন্ধুত্ব স্থাপনের মাধ্যমে মাদকসেবীদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখি এবং মাদকসেবী রাজিব (২৭) (ছদ্মনাম) সাথে কথা বলি। সে জানায় উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মনসুর আহমেদ এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির ঘনিষ্ঠজন সেলিম এর কাছ থেকে মাদক সংগ্রহ করে। সেই সূত্র ধরে সেলিম সাথে যোগাযোগ করলে সে আমাদের সাথে কথা বলতে রাজি হয়নি। আমি পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কথা বলতে চাইলে সে জানায়, জেলা ও উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ বাজারে প্রতিরাতে চলে ইয়াবা, ক্রিস্টাল ম্যাথ, গাঁজা, মদ, কোকেন ও ড্যান্ডির আসর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আসর আর যেখান থেকে সব মাদক সাপ্লাই হয় সেটি হলো উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মনসুর আহমেদ এর চাউল ব্যবসার আড়ালে।

কিশোররা প্রথমত কৌতূহলবশত মাদক গ্রহণ করে যা পরবর্তীতে নেশায় পরিণত হয়। সাধারণত একটু বিত্তবান পরিবারের সন্তানরা ইয়াবা ও ক্রিস্টাল আইস সেবন করে থাকে, যখন টাকা যোগাড় করতে না পারে তখন টাকা জোগাড়ের জন্য বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ে। হোটেলের খাবারের সাপ্লাইকারি সবজি বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি তারা সীমান্ত থেকে পরিবহনে করে চাউল-পিয়াজ বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী নিয়ে আসার সময় তাদেরকে বাধ্য করা হয় কিছু অবৈধ মালামাল নিয়ে আসার জন্য। তারা জানান তারা যদি এগুলো নিয়ে না আসে তবে তাদের সাথে ব্যবসা করবে না বলে জানায় হোটেল কর্তৃপক্ষ। হোটেলের সাথে তাদের ব্যবসার চুক্তি বাতিল করা হবে, তাই তারা বাধ্য হয়েই নিয়ে আসে। ট্রাক ড্রাইভারের সাথে কথা বলে জানতে পারি সীমান্ত থেকে পণ্য পরিবহন করার সময় প্রভাবশালী কিছু লোক তাদেরকে বাধ্য করায় মাদক পরিবহন করার জন্য। তারা পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত করে বলেন মনসুর চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজনেরা এগুলো ব্যবস্থাপনা করে থাকে। তারা হুমকি দিয়ে বলে যদি এসব না করে তাহলে মিথ্যা মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে দেবে। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে মাদকের স্পটগুলো জমে উঠে ঢাকাদক্ষিণ বাজার, ঢাকাদক্ষিণ স্কুল এর খেলার মাঠ এবং তার সংলগ্ন পরিত্যক্ত বিল্ডিং, ঢাকাদক্ষিণ দীঘিরপার, ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন পুরাতন পানীসমপদ এর বিলডিং, ঢাকাদক্ষিণ বিশ্ববিদ্যালয় কানিশাইল সহ এসব এলাকার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলে জানা যায়, আওমীলীগের সভাপতির তত্বাবধানে এসব মাদকের আসরগুলো পরিচালনা করা হয়। বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্কুলগামী ছাত্রদের টার্গেট করছে সোহেলদের সাঙ্গপাঙ্গরা। তারা জানান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খয়রুল এর ভয়ে অনেকে কথা বলতে নারাজ। খয়রুল এর অনুগত আওয়ামীলীগের কর্মীদের নেতৃত্বে স্কুল- কলেজগামী কিশোরদেরকে প্ররোচিত করে সর্বনাশা মাদকের দিকে ধাবিত করা হচ্ছে। এছাড়াও গড়ে তোলা হয়েছে ২০-২৫ জন সদস্যের কিশোরগ্যাং। এ নিয়ে অভিভাবক মহল উদ্বিগ্ন। সমাজের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি অতি মুনাফার লোভে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। অন্ধকার জগতে অস্ত্রের পরেই লাভজনক ব্যবসা হচ্ছে মাদক।
ঢাকাদক্ষিণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আতাউর রহমান বলেন, আমরা অনেকদিন যাবত প্রত্যক্ষ করছি মাদকের অবস্থা। তিনি জানান অনেক গণ্যমান ব্যক্তিবর্গ এর সাথে জড়িত। তিনি অভিভাবকদের আরো সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন এবং প্রশাসনকে আরো তৎপর হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন।
ভৌগোলিকভাবে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের কারণে আমাদের গোলাপগঞ্জ উপজেলা নানাভাবে নানাপথে বানের জলের মতো মাদক প্রবেশ করছে। যার সিংহভাগ আবার ছড়িয়ে পড়ছে উপজেলার বিভিন্ন মাদক আস্তানায়। প্রশাসনিক দুর্বলতা, আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাব, মাদক কারবারীদের সাথে প্রশাসনের সখ্যতা, স্থানীয় ও জাতীয় জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা কারণে মাদকের ভয়াবহতা আজ কল্পনাতীত। ভৌগলিক অবস্থানের দিক বিবেচনায় তুলনামূলকভাবে নেই অত্র এলাকায় তেমন প্রশাসনিক তদারকি। অত্যন্ত লাভজনক এই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিশাল একটি চক্র। শক্তিশালী এই চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ আমাদের সমাজে সর্বস্তরে দুর্নীতির শাখ-প্রশাখা বিস্তৃত। ফলে যেকোনো অপরাধী বা মাদক কারবারিরা আড়ালে থেকে যায় নিজস্ব কৌশলে। আইন ও প্রশাসন এদের প্রভাবের কাছে নতজানু। পুলিশ বলছে, ‘বিদ্যমান আইনে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ হাতেনাতে মাদক উদ্ধার ছাড়া আমরা কাউকে গ্রেফতার করতে পারি না’।

কথা বলি মাদক বিরোধী সামাজিক সংগঠন “মাদকে না বলি’ উপজেলা শাখার সভাপতি আবদুর রহমানের সাথে কথা বলে তার কাছ থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাই। তিনি উপজেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তার দিকে ইঙ্গিত করে তারাই মাদকের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। তিনি ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস ছাড়াও সচেতনতামূলক নান কর্মসূচি পালনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

এমন এক চলমান সময় আমাদের কাছে খবর আসে, উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ বাজারে বিভিন্ন প্রকার মাদকের চালান এসে পৌছেছে। সেই সূত্র ধরে অতি গোপনীয়তার সাথে আমরা আমাদের সোস্ পাঠিয়ে নিশ্চিত হই এখান থেকে মাদক সরবরাহ করা হচ্ছে।

দীর্ঘদিন ধরে তারা এই সিন্ডিকেট চালিয়ে যাচ্ছেন। যেসকল হোটেল কক্ষগুলোতে এসব মাদক লুকিয়ে রাখা হয় সেগুলোতে রয়েছে নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী এবং সিসিটিভি ক্যামেরা। মাদক ঢুকা এবং বের হওয়ার সময় ক্যামেরাগুলো বন্ধ রাখা হয়। উপজেলার প্রতিটি মানুষের কাছে এই আবাসিক হোটেলের বিষয়ে অজানা নয় কিন্তু যেহেতু মালিকপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় এ বিষয়ে কেউ কথা বলতে নারাজ।