• ২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২৪শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে সিলেটের ঢাকাদক্ষিণ বাজার

sylhetsurma.com
প্রকাশিত জানুয়ারি ২০, ২০২২
মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে সিলেটের ঢাকাদক্ষিণ বাজার

মো. নাছির উদ্দীন, স্টাফ রিপোর্টার:
সিলেট জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জে ও পাড়া-মহল্লায় মাদক ব্যবসা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সমগ্র জেলা থেকে উপজেলা জুড়ে জুয়া ও মরণনেশা মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে। এখানে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে কোকেন, ক্রিস্টাল ম্যাত, ফেনসিডিল, ড্যান্ডি, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য। জুয়া ও মাদকে আসক্ত হয়ে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় যুব সমাজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে যাচ্ছে। কিছু চিহ্নিত জুয়া ও মাদক কারবারীসহ অনেক রাঘববোয়াল এ ব্যবসার সাথে জড়িত। এমনকি দশ বছরের শিশুদের ভেতরেও ড্যান্ডি নামক মাদক সেবনের প্রবনতা দেখা গেছে। দিনের পর দিন তারা এই নিষিদ্ধ কর্মকান্ড চালিয়ে আসলেও রহস্যজনক কারণে জুয়া ও মাদক কারবারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

একাধিক সূত্রে জানা যায়, সিলেট জেলার অন্তর্গত গোলাপগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি স্পটে রয়েছে মাদক ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণ ভয়ে মুখ খুলতেও নারাজ। গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ, বড়লেখা, জইনতাপুর, সহ বিভিন্ন উপজেলা ভিত্তিক মাদকের ডিলাররা দীর্ঘদিন ধরে মাদকের চোরাচালান ব্যবসা করে আসছে। এছাড়াও উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ বাজারসহ একাধিক স্পটে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার মাদক বিক্রি করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন মাদক বিক্রেতা জানান উপজেলায় কমপক্ষে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি মাদকের ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে। তাছাড়া মাদকের ব্যবসায় লগ্নি আছে বেশ কয়েকজনের। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তারা মাদক ব্যবসা করে আসছেন এবং এর সাথে কয়েকজন জনপ্রতিনিধিও যুক্ত রয়েছেন। মূলত প্রভাবশালী কয়েক ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় কেনা-বেচা হয় মাদক। আর বিভিন্ন পন্থায় মাদক পৌঁছে দেওয়া হয় উপজেলার বিভিন্ন স্থানে।

সরেজমিনে দেখা যায়, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ এবং বড়লেখা বাজারের আবাসিক হোটেলসহ, মুদির দোকানে-দোকানে ও চায়ের স্টলগুলোর পিছনে-সামনে ভিতরে পর্দা ও বেড়া টানিয়ে চলছে রমরমা ক্যারম বোর্ড, তাস, গাফলা ও মোবাইল দিয়ে লুডু খেলার নামে জুয়া খেলা এবং গাঁজা সেবন। আবাসিক হোটেলগুলোতে রুম ভাড়া নিয়ে রাতভর চলে মাদক সেবণ আর মাদকের চোরাচালান। হোটোলের মালিক কর্মচারীরাও এসবের সাথে জড়িত। দিনের বেলায় এসব জুয়ারী ও মাদক কারবারীদের তেমন একটা চোখে না পড়লেও সন্ধা নামতেই তাদের আনাগোনা বেশ লক্ষনীয়। সূত্রমতে, সিলেট-গোলাপগঞ্জ-জকিগঞ্জ রোডে মাদক পাচারে কিছু প্রভাবশালী নেতার দামি গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ বহুদিনের। মূলত সীমান্ত এলাকা থেকে নদী ও সড়ক পথে মাদক ঢুকছে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, গত উপজেলা নির্বাচনের পর থেকেই এ অবস্থা দাঁড়িয়েছে, এর আগে এমন অবস্থা ছিল না। প্রকাশ্যে দীর্ঘদিন ধরে দুষ্কৃতকারী চিহ্নিত ব্যক্তিরা মাদকের ব্যবসা চালিয়ে আসছে।
জানা যায়, থানা ও গোয়েন্দা ইউনিটে রয়েছে পুলিশের সোর্স তথ্য সংগ্রহ ও অপরাধী ধরতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে কাজে লাগায় পুলিশ। সোর্সদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অপরাধমূলক কাজের অভিযোগ। সোর্সদের মধ্যে অনেকেই আবার মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে সুবিধা নিচ্ছে। এসব সোর্সদের কারণে অনেক সময় প্রশাসনও পাচ্ছে না সঠিক তথ্য। এমনকি মাদক বিরোধী অভিযানের তথ্য সোর্সদের মাধ্যমে আগাম পেয়ে যায় মাদক ব্যবসায়ীরা। শীর্ষ ইয়াবা ও মাদক ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে নিজেদের রূপ পাল্টে নিয়েছেন প্রশাসনের নজর থেকে এড়িয়ে যেতে। পুলিশ এ পর্যন্ত চিহ্নিত কোনো শীর্ষ ইয়াবা ও মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করতে পারেনি। দু একজন কদাচিৎ ধরা পড়লেও দ্রুত জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও দ্বিগুণ উৎসাহে মাদক কারবার শুরু করে। অন্যদিকে নিধিরাম সরদারের ভূমিকায় মাদকদ্রব্য নির্মূল অধিদপ্তরের লোকজনও জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে হাত গুটিয়ে থাকছেন।

পূণ্যভূমি সিলেটের গোলাপগঞ্জ মাদকের বিস্তার অনেক বেড়ে গেলেও ঊর্ধ্বতন মহলের তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ হয়নি এখন পর্যন্ত। ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে হাওর ও নদীর পার এবং জাতীয় মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী হওয়ায় প্রশাসনের নাকের ডগায় মাদক পাচারকারীরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘেœ। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে মদ, গাঁজা ও হিরোইন, ফেনসিডিল, কোকেন, ড্যান্ডি, ইয়াবাসহ নানা ধরণের নেশাজাত সামগ্রী। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের অনৈতিক সুবিধা দিয়েই এসব অসামাজিক কর্মকান্ড চলছে, আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উপজেলার একাধিক স্থানে মাদকের রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা। মাদক বিস্তারের ফলশ্রুতিতে উপজেলার সমাজব্যবস্থা, মূল্যবোধ, আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। বিশেষ করে ছাত্র ও যুব সমাজ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মাদকের ছোবলে যুবকদের পাশাপাশি পথশিশুরাও বিপথগামী হচ্ছে। নেশা গ্রহণকারী শিশু-কিশোরদের মধ্যে বেশিরভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। এসব যুবকরা গাঁজা, ফেন্সিডিল, জুতায় লাগানোর পেস্টিং (ড্যান্ডি), চোলাই মদসহ সর্বনাশা ইয়াবা ও হিরোইনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদক সহজলভ্যতার ফলে দিন দিন সেবনকারী ও বিক্রেতারদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলছে। অন্যদিকে, নেশার জন্য টাকা জোগাড় করতে বাড়ছে চুরি, ছিনতাইয়ের মতো একাধিক ছোট-বড় অসামাজিক ঘটনা। পথশিশুদের ভেতরের ড্যান্ডি সেবনের বিশেষ কিছু ঘটনা ইতিমধ্যে নজর কেড়েছে জনগনের। যারা সারাদিন ভিক্ষার উপার্জিত অর্থ দিয়ে সন্ধ্যা নামলে ড্যান্ডির নেশায় বুদ হয়ে থাকে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে চোখে পড়ার মত কোন উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে ৫৫ শতাংশ মাদকসেবীর বয়স ২২ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ একজন মানুষের জীবন গড়ার এবং সমাজ ও পরিবারকে কিছু দেওয়া উপযুক্ত সময় এটি। অথচ মাদক আসক্তির ফলে জীবনের মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ এই সময়টা নষ্ট করছে অনেক তরুণ আর সমাজ দিন দিন পৌঁছে যাচ্ছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। গত এক যুগে বিভিন্ন সংস্থা প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক সবচেয়ে বেশি উদ্ধার করা হয়েছে ইয়াবা, হেরোইন, কোকেন, আফিম, গাঁজা ও ফেনসিডিল। বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ঘটনায় উল্লিখিত সময়ে ৭ লক্ষাধিক মামলায় ১০ লক্ষাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। উদ্ধারের চিত্র থেকেই স্পষ্ট, দেশে নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্যের বিস্তার কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বস্তুত, দেশে মাদকদ্রব্যের বিস্তারের প্রকৃত চিত্রটি আরও ভয়াবহ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ঘটনাই উদঘাটিত হয় না; যে পরিমাণ মাদক ধরা পড়ে, তা খুবই সামান্য। বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী, অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানিতে প্রতিবছর বিদেশে পাচার হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। নেশাজাতীয় দ্রব্যের বিস্তারে সেবনকারীর আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে। এ অবস্থা রোধ করা না গেলে একটি প্রজন্মের চিন্তার জগতে সৃষ্টি হবে বন্ধ্যত্ব। দীর্ঘমেয়াদে এর ফল কতটা ভয়াবহ হবে, তা সহজেই অনুমেয়। স্কুল কলেজগামী শিক্ষার্থীরা কৌতূহলবশত এবং সহপাঠীদের প্ররোচনায় দ্রুত মাদকের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিককালে গোলাপগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত এলাকাসমূহে মাদকের বিস্তার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়টি সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে।

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য গোলাপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মনসুর আহমেদ এর সাথে সাক্ষাৎ করলে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তিনি এগুলো তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে মন্তব্য করেন এবং এসব বিষয়ে নাক গলাতে নিষেধ করেন।

স্থানীয় স্কুল শিক্ষক বিজয় চন্দ দাসের সাথে কথা বললে তিনি জানান, দেশের অন্যান্য সামাজিক সমস্যার মধ্য থেকে মাদক সমস্যা এখন তীব্র আকার ধারণ করছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীরা এতে আকৃষ্ট হচ্ছে। স্কুল বয়সী শিক্ষার্থীরা মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরিবার তথা সমাজে বিধ্বংসী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ থেকে উত্তরণ না ঘটলে সমাজ তথা দেশের ধ্বংস অনিবার্য।
স্থানীয় সালিশ ব্যক্তিত্ব ও সমাজসেবক জাহিদ হোসাইন জানান, উপজেলা নির্বাচন পরবর্তী সময় থেকে মাদকের ব্যবহার ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন- “আমি ইতিমধ্যে ১০/১২ টি অভিযোগে মীমাংসা করে দিয়েছি। ছাত্র যুব সমাজ মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সমাজে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। মাদকের টাকা যোগাড় করতে না পেরে চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে”। তিনি অভিভাবকদের আরো সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেদ ইকবাল “জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে প্রতি মাসে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়ে থাকে। গোলাপগঞ্জের মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অচিরেই অভিযান পরিচালনা করা হবে”।
থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হারুনুর রশীদ চৌধুরী মাদকের সয়লাবের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, “আমাদের কাছে অভিযোগ আছে কিন্তু সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে আমরা পদক্ষেপ নেবো”।