বাংলা ভাষাকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাঙালিরা বুকের রক্ত ঢেলে আদায় করে নিয়েছিল মাতৃভাষার অধিকার। ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পর বাংলা ভাষার টানে বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন এক পাকিস্তানি তরুণ। বাংলা শিখতে ভর্তি হয়েছেন এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়েও।
মো. তাহির ওয়াহিদ নামের এই যুবকের বাড়ি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গুজরানওয়ালা শহরে। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করেছেন তিনি। এবার আরও ভালো বাংলা শিখতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছেন।
একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিতে বাংলাদেশে এসেছেন তাহির। সম্প্রতি সিলেটে বেড়াতে এসেছিলেন তিনি। গত শনিবার তাহিরের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। স্পষ্ট বাংলায় কথা বলেন এ পাঞ্জাবি যুবক।
ইতিহাস বইতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে পড়তে গিয়েই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তাহির। তিনি বলেন, ‘ইতিহাস বই পড়েই জানতে পারি, বাঙালিদের আলাদা ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। তৎকালীন শাসকরা এই ভাষা ও সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। এ কারণে পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেছে।
‘দুই দেশের মধ্যেও অনেক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এসব জেনে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। এসব ইতিহাস জেনে আমি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠি।’
এই আগ্রহ থেকেই পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন তাহির। তিনি বলেন, ‘বাংলা নিয়ে পড়ার কথা জানালে পরিবার প্রথমে আপত্তি জানিয়েছিল। কারণ বাংলা পড়ে দেশে চাকরির তেমন সুযোগ নেই, তবে পরে আমি পরিবারকে বোঝাতে সক্ষম হই।’
২০০৩ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সও সম্পন্ন করেন তাহির, কিন্তু সার্টিফিকেট দিলেও করাচি বিশ্ববিদ্যালয় তার বাংলা শেখার আগ্রহ মেটাতে পারেনি বলে জানান তিনি।
তাহির বলেন, ‘করাচিতে বাংলা বিভাগে আমিই একমাত্র ছাত্র ছিলাম। বাংলার ভালো শিক্ষকও সেখানে ছিলেন না। এ ছাড়া বাংলা বিষয়ে বইপত্রও খুব কম।’
তাহির জানান, বইপত্র আর শিক্ষক সংকটও বাংলার প্রতি আগ্রহ কমাতে পারেনি তার। ইউটিউবে ভিডিও দেখে বাংলা পড়া ও লেখা শেখেন তিনি। বাংলা ভাষা শিখতে ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে তিনি পাকিস্তানে বসবাসরত বাঙালিদের সঙ্গে মিশতে শুরু করেন।
তিনি আরও জানান, বাঙালিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া-আসা করতেন, কিন্তু তাতেও আশা মিটল না তার। কারণ সেখানে বসবাসরত বাঙালিরা প্রমিত বাংলা তেমন জানেন না। আঞ্চলিক ভাষা জানেন কেবল।
পাকিস্তানে বেশ কিছু শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় হয় তাহিরের, যারা পাকিস্তানে বাংলা গান চর্চা করেন, বিশেষত বাউল গান করেন। তাদের গান মুগ্ধ করে তাহিরকে। তিনি সোশ্যাল মিডিয়া আর মূলধারার গণমাধ্যমের মাধ্যমে তাদের গান প্রচারের উদ্যোগ নেন।
তাহিরের ভাষ্য, ‘আমি চেয়েছি নতুন প্রজন্মের পাকিস্তানিরা জানুক এখানে আরেকটি সংস্কৃতির লোক রয়েছে, যাদের ভাষা ও সংস্কৃতি খুব সমৃদ্ধ।’
বাংলা গানের শিল্পীদের সঙ্গে মিশে বাউল আর সুফি দর্শন সম্পর্কে কিছুটা অবগত হলেও বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও ভালো করে জানার আগ্রহ অপূর্ণই থেকে যায় তাহিরের। সেই আগ্রহ থেকেই চলতি বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হন তাহির।
ভর্তি হতে পেরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও একটি খেদও রয়েছে তার। তাহির বলেন, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পাকিস্তানি হওয়ায় আমাকে ভর্তি করা হয়নি। এটা খারাপ লেগেছে।’
পড়ালেখা শেষ করে পাকিস্তানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছার কথা জানিয়ে তাহির বলেন, ‘পাকিস্তানে বাংলা স্কুল খুলতে চাই। সেখানকার নতুন প্রজন্ম বাংলা জানে না। তাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা ও শেখার সুযোগ করে দিতে চাই। পাকিস্তানে বসবাসরত বাঙালি কমিউনিটির জন্য কাজ করতে চাই।’
বাংলা সংস্কৃতিকে বর্তমান প্রজন্মের পাকিস্তানিদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়ার লক্ষ্যের কথা জানিয়ে তাহির বলেন, ‘আমি তিক্ত সম্পর্কের মধ্যে দুই দেশের মানুষের মধ্যে সেতু হিসেবে কাজ করতে চাই, যাতে তারা একে অপরকে জানতে পারে।’