• ২৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৪ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২৬শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

ভয়ংকর টিলাগড় পয়েন্ট

sylhetsurma.com
প্রকাশিত অক্টোবর ২৩, ২০১৭
ভয়ংকর টিলাগড় পয়েন্ট

মো: আমিন উদ্দিন
টিলাগড়। সিলেট নগরীর আলোচিত একটি এলাকা। ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ, সিলেট সরকারি কলেজ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এ এলাকায় অবস্থিত। এখানে রাজনৈতিক সংঘর্ষে রক্ত ঝরার ইতিহাস যেমন আছে, তেমনি আছে নিরীহ মানুষ খুনের ঘটনাও। পুরো সিলেট নগরীতে যে পরিমাণ অপরাধ সংঘটিত হয় তার চেয়ে বেশি হয় এই এলাকায়। শুধু টিলাগড় নয় নগরীর বিভিন্ন জায়গায় খুনের সাথে জড়িত রয়েছে টিলাগড়ের ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। একের পর এক হত্যা, সংঘর্ষ ও অস্ত্রের মহড়ার ঘটনায় ‘কিলিং জোন’-এ পরিণত হয়েছে টিলাগড়। কিন্তু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে প্রশাসনের দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রভাব বিস্তার, সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা কারণে একের পর এক হত্যাকা- ঘটছে টিলাগড়ে। এসব অপকর্ম রোধে ছাত্র সংগঠনগুলোতে বহিষ্কার, কমিটি স্থগিতসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
নগরীর টিলাগড় পয়েন্টে গত ১৬ অক্টোবর সোমবার বিকেলে খুন হয়েছেন ছাত্রলীগকর্মী ওমর আহমদ মিয়াদ। দলীয় কোন্দলের জেরে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিপুর আশীর্বাদ পুষ্ট সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সেক্রেটারী রায়হান চৌধুরীর গ্রুপের ক্যাডার তোফায়েল আহমদসহ কয়েকজনের সাথে সংঘর্ষ হয় মিয়াদ ও তার সঙ্গীদের। একপর্যায়ে ছুরিকাঘাতে খুন হন ওমর আহমদ মিয়াদ। এ ঘটনায় তোফায়েলকে ঢাকা থেকে আটক করেছে এসএমপির মোগলাবাজার থানার সহকারী পুলিশ কমিশনার জ্যোতিময় দাস সহ একদল পুলিশ। বর্তমানে তোফায়েল পুলিশ হেফাজতে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মিয়াদ খুনের ঘটনায় ছাত্রলীগ সেক্রেটারি রায়হান চৌধুরীসহ ৯ জনকে আসামী করে মিয়াদের বাবা আকুল মিয়া শাহপরাণ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে।
এর এক মাস আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর নগরীর শিবগঞ্জ লামাপাড়ায় খুন হন ছাত্রলীগকর্মী জাকারিয়া মো. মাসুম। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে তার ভাই সাইফুল্লাহকে আটকে মাসুমকে ডেকে আনেন টিলাগড়েরর ছাত্রলীগ নেতা টিটু চৌধুরী ও তার সঙ্গীরা। পরে ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় মাসুমকে। তার মা আতিয়া বেগম বাদী হয়ে টিটুকে প্রধান আসামি করে ২২ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। তন্মধ্যে গৌতম চন্দ্র ও আলী আহমদ জুয়েল নামের দুইজনকে গ্রেফতার করা হলেও মূলহোতা টিটুসহ অন্যরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে আসামিদের গ্রেফতারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন নগরীর শাহপরান থানার ওসি আখতার হোসেন।
একই বছর ১০ জুলাই নগরীর পাঠানটুলায় একটি বাসার দখল নিয়ে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় খুন স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা আব্দুল্লাহ অন্তর। তার স্ত্রী বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু এখনও বিচারের আশায় দিন পার করছেন তিনি।
গত বছরের ১৯ জানুয়ারি দলীয় ক্যাডারদের হামলায় খুন হন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগকর্মী কাজী হাবিবুর রহমান হাবিব। এ ঘটনায় অভিযুক্ত হন ছাত্রলীগ নেতা হোসাইন মোহাম্মদ সাগর ও সোহেল। তাদের নেতৃত্বেই হাবিবের ওপর হামলা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৪ ছাত্রকে বহিষ্কার করে। এরা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। এদেরকে আসামি করে হাবিব হত্যায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলার আসামিদের কয়েকজন গ্রেফতার হলেও পরবর্তীতে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসে।
সিলেট মদন মোহন কলেজে অভ্যন্তরীণ বিরোধে ২০১৫ সালের ১২ আগস্ট খুন ছাত্রলীগকর্মী আব্দুল আলী। এ ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা প্রণজিৎ দাশ ও আঙ্গুর মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রণজিৎ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তবে মামলার বিচারকার্য শেষ হয়নি এখনও।
২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হল দখল নিয়ে পার্থ ও সবুজ গ্রুপের সঙ্গে অঞ্জন-উত্তম গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগকর্মী সুমন চন্দ্র দাস। তার মা প্রতিমা দাস বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। বর্তমানে মামলাটি সিআইডিতে তদন্তাদীন অবস্থায় রয়েছে।
অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে ২০১০ সালের ১২ জুলাই নগরীর টিলাগড়ে খুন এমসি কলেজের গণিত বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগকর্মী উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। এ ঘটনায় তার বাবা বীরেশ্বর সিংহ বাদী হয়ে ছাত্রলীগের আটজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। পুলিশ মূল অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে ছয়জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। ওই খুনের বিচার এখনও শেষ হয়নি।
সিলেটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নাম গত প্রায় সাত বছরে ৭টি খুনের সাথে জড়িয়েছে। শুধু ৭টি খুন নয়, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে হামলা পাল্টা হামলায় শতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের উপর হামলাতো আছেই। কখনও ছাত্রলীগ পুলিশী ছত্রছায়ায় ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আবার কখনও পুলিশের সাথে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে হামলা করেছে। এসবই নজরে রয়েছে সিলেটবাসীর।
আর ছাত্রলীগের এসব নেতিবাচক কর্মকান্ড বেশিরভাগই পরিচালনা করা হয় টিলাগড় থেকে। ২০১২ সালের ৮ জুলাই রাতে ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষে ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের ৩টি ব্লকের ৪২টি কক্ষ পুড়িয়ে দেয়া হয়। এ মামলার আসামিদের আস্তানাও টিলাগড়কেন্দ্রিক।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, টিলাগড় এলাকায় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিপুর অবৈধ অস্ত্রের মজুদ রয়েছে। আর তা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার শেল্টারে রয়েছে। অবৈধ অস্ত্রের জোগান মূলত সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে আসে।
পুলিশ সূত্রে ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ৯ বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে টিলাগড় এলাকায় কমপক্ষে ৩০টির বেশি সংঘর্ষ হয়েছে। প্রতিটিতেই অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। একের পর এক খুন, সংঘর্ষে উদ্বিগ্ন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
ছাত্রলীগের অভিভাবক সংগঠন হিসেবে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগের নেতারাও ইমেজ সংকটে পড়েছেন। সোনার ছেলেদের আপত্তিকর কর্মকান্ডে বিব্রতবোধ করছেন মুরব্বী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইমেজদারী নেতা হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত আসাদ উদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের এমন কর্মকান্ডে আওয়ামী লীগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছি এবং প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি। শক্তভাবে না ধরলে আগামীতে আরো খারাপ অবস্থা হবে বলে মন্তব্য করেন নগর আওয়ামী লীগের এই নেতা।