মো: আমিন উদ্দিন
সিলেটে ৩৭ জন মোটরসাইকেল চোরকে সনাক্ত করেছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ ( এসএমপি)। সনাক্ত করা চোরদের অনেকেই সিলেটে রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে রয়েছেন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের প্রশ্রয়ে রয়েছেন বেশিরভাগ চোর। এরা নেতাদের মিছিল মিটিংয়ে অংশ নেন এবং সুযোগ পেলেই সাধারণ মানুষের মোটরসাইকেল চুরি করেন। ৩৭ জন চোরের মধ্যে ১০ জনই ছাত্রলীগ নেতা হিরন মাহমুদ নিপু গ্রুপের সাথে জড়িত রয়েছেন বলে এসএমপির তৈরি করা তালিকা থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সিলেটে সম্প্রতি প্রতিদিনই মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটছে। ভুক্তভোগীদের কেউ আইনের আশ্রয় নেন, কেউ নেন না। চুরির ঘটনায় মোটর সাইকেল মালিকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বিষয়গুলো ভাবিয়ে তুলেছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনীকেও। মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠা মোটর সাইকেল চোরদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে নানা তৎরতা চালাচ্ছে তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ৩৭ জনের একটি তালিকা তৈরি করে মাঠে নেমেছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনী। এই ৩৭ জনই সিলেট বিভাগজুড়ে মোটর সাইকেল চুরি করে মানুষের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চুরি করা মোটর সাইকেল দক্ষিণ সুরমার নর্থ-ইস্ট মেডিকেল কলেজের আন্ডারগ্রাউন্ড, জিন্দাবাজারের আল-হামরা শপিং সিটি, মিরবক্সটুলার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও শাহপরাণ থানা এলাকার হিলভিউ টাওয়ার এর আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে রাখা হয়। এগুলোর বাইরে চোরদের ‘নিজস্ব’ কিছু গ্যারেজ আছে। সেগুলোতেও তারা চুরি করা মোটর সাইকেল রাখে। এক্ষেত্রে তারা আশ্রয় নেয় কৌশলের। মোটর সাইকেল খুলে টুকরো টুকরো করে ফেলে। তারা কখনো সংঘবদ্ধ হয়ে, আবার কখনো আলাদাভাবে এমন কর্ম করে।
পুলিশের তৈরি করা তালিকার প্রথমেই আছে দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি গাঙু এলাকার ফারুক মিয়ার ছেলে মনির আহমদ ইমন (২৬)। তাকে মোটর সাইকেল চোরদের ‘দলনেতা’ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে তালিকায়। সে কখনো নিজ জালালপুর এলাকার মিয়াজান আলীর বাড়ি, কখনো মামা আবদুর রহমান লন্ডনীর বাড়ি আবার কখনো নগরীর উপশহর এলাকায় থাকে। তার বিরুদ্ধে ৬ টি মামলা রয়েছে।
এরপর আছে দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দির মৃত দুদু মিয়ার ছেলে মাইদুল (৩০)। তিন মামলার আসামী মাইদুল চোর চক্রের স্বক্রিয় সদস্য। দেড় বছর আগে বাড়ি বিক্রি করে সে সিলাম চলে যায়।
তার সহোদর বদরুল (৩০)ও চোর চক্রের স্বক্রিয় সদস্য। তার বিরুদ্ধেও তিন মামলা রয়েছে। ভাইয়ের মতো বদরুলও গৃহত্যাগী। তালিকার তিন নম্বরে তার স্থান।
তালিকার চার নম্বরে আছে ছাতক উপজেলার গোবিন্দনগরের মৃত নজির আহমদের ছেলে তারেক আহমদের (২৯) নাম। নগরীর জালালাবাদ থানা এলাকার মদিনা মার্কেটে থাকে সে। চোর চক্রের স্বক্রিয় এই সদস্যের বিরুদ্ধে রয়েছে ৬ মামলা।
তালিকার পাঁচ নম্বরে রয়েছে দুর্র্ধর্ষ চোর মোখলেছুর রহমানের (৩৩) নাম। তার বিরুদ্ধে ৮ মামলা। সে জেলেই আছে। কিশোরগঞ্জের নিখলী থানা এলাকার রসূলপুরের মৃত ছেনু মিয়া মেরাজের ছেলে সে । থাকে নগরীর মেন্দিবাগে জালালাবাদ গ্যাস অফিসের পাশে আলমগীরের কলোনীতে। এর পরেই আছে দক্ষিণ সুরমার গোটাটিকর পূর্বপাড়ার শহীদ আলীর ছেলে কয়েস আহমদ (৩০)। সে মোটর সাইকেল চুরি করতে গিয়ে কয়েকবার গণধোলাইও খায়, জেল খেটেছে কয়েকবার। চোর চক্রের স্বক্রিয় এই সদস্যের বিরুদ্ধে আছে ২ মামলা।
তালিকার ৭ নম্বরে চোর চক্রের স্বক্রিয় সদস্য হিসেবে নাম আছে নগরীর পাঠানটুলার মোহনা ব্লকের এ ২৯/৫’র তাহের আলী পাখি মিয়ার ছেলে সেলিম আহমদের (৩০)। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ৪ মামলা। এরপর আছে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ থানাধীন কদিমঙ্গল এলাকার স্বপন মিয়ার ছেলে মেহেদি হাসানের নাম। সে নগরীর উপশহর এলাকায় একটি কলোনীতে থাকে। চোর চক্রের স্বক্রিয় এই সদস্যের বিরুদ্ধে ৩ মামলা রয়েছে।
তালিকার ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৩ নম্বরে রয়েছে জৈন্তাপুরের রাইরাখেলের মৃত আলকাছ মির্জার ছেলে মো. সাব্বীর মির্জা (৩০), বিশ্বনাথের রশিদপুর এলাকার আবদুস সানিকের ছেলে রাসেল আহমদ, জালালাবাদ থানা এলাকার হাইদরপুরের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে সোহেল, শাহপরাণ থানা এলাকার খাদিমপাড়ার সফিক হোসেনের ছেলে আখতার হোসেন, মৌলভীবাজার সদরের ভৈরববাজার গিয়াসনগর এলাকার মেহের আলীর ছেলে লিটন ওরফে শাহীন (৩০)। সে নগরীর আখালিয়া নতুনবাজারের শাহেদের কলোনীতে থাকে । চোর চক্রের স্বক্রিয় এই পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে ২ টি করে মামলা রয়েছে।
তালিকার ১৪ থেকে ৩২ পর্যন্ত নম্বরে রয়েছে ছাতকের দশঘর এলাকার সিরাজের ছেলে আউয়াল হোসেন, উপশহরের তেররতন সাদারপাড়ার ৪৮/এ’র মৃত ওহাব আলীর ছেলে আবদুল মালেক (৩৫), ছাতকের দশঘর এলাকার আবুল লেইছের ছেলে আবু তাহের (১৬), একই এলাকার তাজ উদ্দিনের ছেলে হোসাইন আহমদ (১৬), জালালাবাদ আবাসিক এলাকার গোয়াবাড়ির মন্তাজ মিয়ার ছেলে কবির আহমদ (২৬), জালালাবাদ থানা এলাকার মদিনা মার্কেট নির্বাসী ৩১-এর মৃত আবদুল মতলিবের ছেলে গোলাম রব্বানী (৩৫), ছাতকের দিখালীর মৃত এখরাছ মিয়ার ছেলে এমরান হোসেন (২৭), জালালাবাদ থানা এলাকার হাওলাদারপাড়ার কালিয়ারা-৯ এর মুর্শেদ আলীর ছেলে আঙুর মিয়া (২৯), মোগলাবাজার থানা এলাকার গোটাটিকরের হারুনুর রশিদের ছেলে হাবিবুর রহমান, শাহপরাণ থানা এলাকার সৈয়দপুরের তোতা মিয়ার ছেলে রুবেল, একই এলাকার ইসলামপুরের একটি কলোনীর জামাল মিয়ার ছেলে কামরুল ওরফে কব্বুল, এয়ারপোর্ট থানা এলাকার বাইশটিলার মো. হানিফের ছেলে ইয়াসিন আরাফাত (১৬), মৌলভীবাজারের রাজনগরের গালিমপুর এলাকার মৃত সিদ্দিক আলীর ছেলে করিম আহমদ, দক্ষিণ সুরমার দক্ষিণ বলদি রাজবাড়ির রাজু আহমদের ছেলে সানজিদ আহমদ হাসান, দক্ষিণ সুরমার কৃষ্ণপুরের লোকমানের ছেলে লিটন, শাহপরাণ থানা এলাকার শান্তিবাগের মুজিবুর রহমানের ছেলে মো. এরশাদ (২৬), একই এলাকার সবুজবাগের আবদুল জলিলের ছেলে সাদ্দাম হোসেন (২১), জকিগঞ্জের পীরনগর কাজী বাড়ির মৃত কাজী আবদুল খালিকের ছেলে কবির আহমদ (৩২), নগরীর সওদাগরটুলা-৭২ এর আনোয়ার হোসেন আনা মিয়ার ছেলে ইকবাল হোসেনের (৩৪) নাম। আবদুল মালেক ছাড়া বাকি ১৭ জনের বিরুদ্ধে রয়েছে ১ টি করে মামলা। আবদুল মালেকের বিরুদ্ধে আছে ২ মামলা। পুলিশের খাতায় এরা প্রত্যেকেই চোর চক্রের স্বক্রিয় সদস্য।
তালিকার ৩৩ থেকে ৩৬ নম্বরে জালালাবাদ থানা এলাকার পাঠানটুলার মাজেদ, দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকার দিলু (২৪), হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের নয়নী এলাকার লেবু মিয়ার ছেলে নয়ন (২৮), মোগলাবাজার থানা এলাকার শিববাড়ির একটি কলোনীর হাসন আলীর ছেলে আরশ আলী’র (২৭) নাম রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকলেও পুলিশের তালিকায় তারা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে চোরচক্রের স্বক্রিয় সদস্য হিসেবে।
পুলিশের তৈরি করা তালিকার সর্বশেষ নাম ফরিদুল আলম (৩৭)। কুটি মেম্বার হিসেবেই যার পরিচিতি। তার বাড়ি দক্ষিণ সুনামগঞ্জের দুর্গাপুরে। তার বাবার নাম আজিম উল্লা। দুই মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চুরি হওয়া বেশিরভাগ মোটর সাইকেল কুটি মেম্বারের কাছে চলে যায়। উল্লেখিত চোরদের সাথে রয়েছে তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ। চুরি করা মোটর সাইকেল তার মাধ্যমেই বিক্রি হয়। এক্ষেত্রে দলনেতা ইমন তার ‘ছায়াসঙ্গি’।
তালিকার ১ থেকে ১০ নম্বর পর্যন্ত সবাইর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিরণ মাহমুদ নিপুর। এসব চোরাই মোটরসাইকেল বিক্রির টাকা থেকে একটি অংশ নিপুর কাছে যায় বলে জানা গেছে। তারই ছত্রছায়ায় থেকে দিনদুপুরে দেদারসে মোটর সাইকেল চুরি করে যাচ্ছে চক্রটি।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার জেদান আল মুসা। মোটর সাইকেল চোরদের তালিকা তৈরিতে অনেক সময় ব্যয় হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি জানান, চোরদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, তালিকা আরো বড় হতে পারে।