আব্দুল হালিম :::
‘‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন শুরু হয় ১৯৯৩ইং সনে। বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সহধর্মীনি জাহানারা কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠনের ব্যানারে এই আন্দোলনের সূচনা করেন ইলিয়াস কাঞ্চন। তখনকার প্রেক্ষাপটে এই আন্দোলনের যোক্তিকতা কতটুকু ছিল এমন প্রশ্ন থাকলেও আজকের বাস্তবতায় সেটি নেই। কারণ সড়কে প্রতিনিয়ত শত শত মানুষ আহত-নিহত হচ্ছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন লাখো মানুষ। এসব মানুষ এখন কেবলই সমাজ বা দেশের বোঝা বলেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু কেন এমন হলো, এর জন্য দায়ী কারা?
একটা সময় সড়ক দুর্ঘটনাকে নিচক দুর্ঘটনা বা ভাগ্যের নির্মমতা অথবা কপালের লিখন হিসাবেই ছেড়ে দেওয়া হতো। দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে বলা হতো আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে। আসলে ব্যাপারটি কী তাই? আজকের বাস্তবতায় এসব অলৌকিকতায় বিশ্বাস করার কোনো সুযোগ নেই।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন দীর্ঘ সময় তাঁর আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের মানুষ এবং সরকারকে এটাই বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, সড়ক দুর্ঘটনা শুধুই নিচক দুর্ঘটনা নয় বা ভাগ্যের লিখন নয়। এটি নিরব একটি হত্যাকান্ড। এর থেকে উত্তরণের জন্য যথোপযুক্ত আইন থাকা দরকার।
গত (২৯জুলাই) একটি বাসের চাপায় কুর্মিটোলায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গত চারদিন ধরে রাজধানীতে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলছে। গতবছর সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৩৯৭ জন নিহত ও ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়েছে বলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।
সমিতির পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলা হয়, দেশের মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৮ শতাংশ খবর গণমাধ্যমে এলেও তার ৪০ শতাংশ প্রকাশ পায়।
ট্রাফিক আইন, মোটরযান আইন ও সড়ক ব্যবহার বিধিবিধান সম্পর্কে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। একইসঙ্গে টিভি-অনলাইন, সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সড়ক সচেতনতামূলক বা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়াও জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাট-বাজার অপসারণ, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা, জেব্রাক্রসিং দেওয়া, চালকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, যাত্রীবান্ধব সড়ক পরিবহন আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন, গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার পদ্ধতিগত উন্নয়ন-আধুনিকায়ন, জাতীয় মহাসড়কে কমগতি ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করার কথাও বলেছে সংগঠনটি।
প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক নিরাপত্তা তহবিল গঠন করে দুর্ঘটনায় হতাহতদের চিকিৎসা ও পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করার সুপারিশও করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
এমন বাস্তবতায় গতবছর আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রীসভা৷ দীর্ঘ একবছর ঝুলে থাকার পর পরিবহণ নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই তা অনুমোদন দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়৷ মন্ত্রীসভার চূড়ান্ত অনুমোদনের পর এটি তোলা হবে সংসদে। গত বুধবার (১আগস্ট) আইনটির ভেটিং সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
বিষয়টি হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনাকে কোনোভাবেই নিছক দুর্ঘটনা হিসাবে মেনে নেওয়ার এখন আর সুযোগ নেই। দেশের সকল অপরাধের জন্য আইন থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কেন আইন থাকতে পারে না। ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা ঘটানো, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইলে কথা বলা, মদ্যপান করে গাড়ি চালানো, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালানো এসবক্ষেত্রে কেন ধর্তব্যপূণ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হবেনা? সড়ক দুর্ঘটনা রোধে একটি কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়োপযোগী দাবী সারাদেশের মানুষের। যার ফলে সরকার আইন প্রনয়ণ করতে যাচ্ছে। এটি ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের সফলতা।
যা যা থাকছে নতুন সড়ক পরিবহণ আইনে :
*শিক্ষাগত যোগ্যতা :
আগের আইনে ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিলনা৷ নতুন আইনের খসড়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য চালকের কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি পাসের শর্ত রাখা হয়েছে।
*সহকারী হতেও শিক্ষাগত যোগ্যতা
আগের অধ্যাদেশে সহকারীদের লাইসেন্সের কথা থাকলেও তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত ছিলনা৷ নতুন আইনে চালকের সহকারীরও থাকতে হবে পঞ্চম শ্রেণি পাসের সার্টিফকেট৷ সহকারী হতে বাধ্যতামূলকভাবে লাইসেন্সের বিধান তো থাকছেই৷
লেখকঃ উপ সম্পাদক, দৈনিক সিলেট সুরমা।