• ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২রা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

যুক্তরাজ্যের রয়েল লন্ডন হসপিটালের বিরুদ্ধে বর্ণ বৈষম্যের অভিযোগ : বিক্ষুব্দ বাঙালি কমিউনিটি

sylhetsurma.com
প্রকাশিত এপ্রিল ৩০, ২০২১
যুক্তরাজ্যের রয়েল লন্ডন হসপিটালের বিরুদ্ধে বর্ণ বৈষম্যের অভিযোগ : বিক্ষুব্দ বাঙালি কমিউনিটি

প্রতিবাদ-প্রতিকারে নতুন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ
চঞ্চল মাহমুদ ফুলর :::
যুক্তরাজ্যের স্বনামধন্য চিকিৎসা সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠান ‘রয়েল লন্ডন হসপিটাল’র বিরুদ্ধে বর্ণ বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে। এশিয়ান, বিশেষ করে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ান অভিবাসী, মুসলিম কমিউনিটি এবং কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অব্যাহত বৈষম্যমুলক আচরণে এসব কমিউনিটির লোকজন ভীষণ ক্ষুব্দ। এ ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ বরাবরে অভিযোগ পেশের পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই তদন্ত শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বিক্ষুব্দ বাঙালি কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের স্বার্থরক্ষায় ‘প্যাশেন্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ইউকে’ নামে একটি সংস্থা গঠন করে এর মাধ্যমে প্রতিবাদমুখর হয়েছেন।
সভ্যতার অতি প্রাচীন এক জনপদ যুক্তরাজ্য। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বহুরূপী জাতি-গোষ্ঠীর মিলনকেন্দ্র এই দেশ। কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বব্যাপী যার প্রশংসনীয় পরিচিতি রয়েছে। ওই দেশে মানুষের মঙ্গলের জন্য বিভিন্ন খাতে রাষ্ট্র যে ভর্তূকি দিয়ে থাকে, তা বিশ্বের আর খুব কম দেশেই দেখা যায়। সেই যুক্তরাজ্যের অত্যন্ত নামকরা সেবামুলক প্রতিষ্ঠান রয়েল লন্ডন হসপিটালে ইদানিং এশিয়ান, কৃষ্ণাঙ্গ এবং বিশেষ করে মুসলিম কমিউনিটির লোকজনদের যথাযথ সেবা প্রদান বা শোভন আচরণ করা হচ্ছে না। বরং অযতœ, অবহেলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে অহরহ। এ কারণে ইতোমধ্যেই ভ‚ক্তভোগীরাসহ সচেতন অভিবাসী সমাজ সোচ্চার হয়েছেন এবং এসব নিয়ে যুক্তরাজ্যের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে চলছে তোড়পাড়।
যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম সুত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ভাতগাঁও ইউনিয়নের ছাতারপই গ্রামের অধিবাসী বর্তমান যুক্তরাজ্যের টাওয়ার হ্যামলেটস্-এর বাসিন্দা আব্দুল দয়াছ তাঁর ৮৬ বছর বয়সী মা জহুরা বিবিকে ইউরিন ইনফেকশনের জন্য গত ৬ জানুয়ারি রয়েল লন্ডন হসপিটালে ভর্তি করেন। নিয়ম অনুযায়ী রোগীর সাথে পরিবারের কাউকে হাসপাতালে থাকতে দেয়া হয়নি। কিন্তু ২০০৮ সালে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ায় জহুরা বিবির শরীরের বামপাশ ছিল সম্পূর্ণ অবশ। এ কারণে তিনি সর্বক্ষণ ছিলেন শয্যাশায়ী, নিজে থেকে খাবার খেতে পারতেন না এবং প্রস্রাব-পায়খানায় যাওয়া বা নিজে থেকে উঠে দাঁড়াতে সক্ষম ছিলেন না। বিধায় মা’কে ভর্তির পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আব্দুল দয়াছ বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়ে রোগীর প্রতিদিনকার ‘রিপোর্ট শীটে’ তা রেকর্ড করিয়ে নেন। হাসপাতালে ভর্তির পরও বয়স এবং শারীরিক অক্ষমতা বিবেচনায় আব্দুল দয়াছের পরিবার মাকে নিয়ে ছিলেন খুবই উদ্বিগ্ন। এ কারণে প্রতিদিন অন্ততঃ ২/৩ বার তারা টেলিফোনে অসুস্থ মায়ের খোঁজ-খবর নিতেন। হাসপাতালের দায়িত্বরত কর্মী ‘কোন অসুবিধা হচ্ছে না, সবকিছু ঠিক আছে, আপনার মা ভালো আছেন’ ইত্যাদি মর্মে তাঁদের আশ্বস্ত করতেন।
১২ জানুয়ারি বেলা দেড়টায় হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক টেলিফোন করে আব্দুল দয়াছকে জানান, ‘আপনার মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ।’ বিস্মিত আব্দুল দয়াছ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কেন আমার মায়ের অবস্থা খারাপ হবে? এর কারণ কী?’ ডাক্তার বলেন, ‘পানীয় ও খাবার না খাওয়ার কারণে (ডিহাইড্রেটেড এবং হাইপারনেট্রেমিকের কারণে রক্তে লবণের পরিমাণ খুব বেশী হয়ে যাওয়ায় রক্ত অ্যাসিডযুক্ত হয়ে) শরীর দূর্বল হয়ে পড়েছে। এর ফলে ক্ষতস্থানের ঘা বেড়ে গেছে। বিভিন্নভাবে শরীরের অবস্থা খুবই নাজুক। হয়তো আর খুব বেশী সময় আপনার মা’কে বাঁিচয়ে রাখা যাবে না এবং যে কোন সময়ই যে কোন দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।’ খবর পেয়ে তিনি পাগলের মতো হাসপাতালে ছুটে যান মৃত্যু পথযাত্রী মাকে দেখতে। এ সময় তিনি কর্তৃপক্ষকে বলেন, ‘আপনারা যদি সঠিক সেবাদানে অক্ষম হোন, তবে আমার মাকে বিদায় দিয়ে দিলে আমরা ঊনাকে নিয়ে বাসায় চলে যাবো। মারা গেলে বাসায় আমাদের সবার সামনে-ই মরবেন। অন্ততপক্ষে মৃত্যুর সময় তো মায়ের সামনে থাকবো’। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ অবস্থায় তাঁর মাকে ছেড়ে দিতে অপারগতা প্রকাশ করে এবং অবস্থার একটু উন্নতি হলে পরদিন নিয়ে যেতে বলে। পরে অনুমতি নিয়ে হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে আব্দুল দয়াছ দেখেন তাঁর মায়ের শরীরের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন এবং ঠোঁট-মুখ শুকিয়ে ফেটে গেছে। তাঁর মা পানি ও কিছু খাওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে ছেলেকে ইশারা করলে সাথে সাথেই তিনি মায়ের মুখে পানি তুলে দেন এবং পরে খিচুঁড়ি, ফলমূল ও পানীয় খাওয়ান। পরদিন ১৩ জানুয়ারি জহুরা বিবি’র শারীরিক অবস্থার একটু উন্নতি হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে বাসায় নিয়ে যেতে বলে। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অব্যাহত অযতœ-অবহেলার পরিপ্রেক্ষিতে বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর ক্রমশঃ বৃদ্ধার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এ অবস্থায় ২১ ফেব্রæয়ারি জহুরা বিবিকে রক্ত পরীক্ষার জন্য পুনরায় রয়েল লন্ডন হসপিটালে নিয়ে গেলে তাঁর শারীরিক অবনতিশীল অবস্থার প্রেক্ষাপটে আবারও ভর্তি করা হয়। কিন্তু জীবিত অবস্থায় জহুরা বিবি আর বাসায় ফিরে আসেননি। এ অবস্থায়ই গত ২৫ ফেব্রæয়ারি তিনি হাসপাতালে মারা যান। লন্ডনের স্থানীয় একটি মুসলিম কবরস্থানে তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়।
একজন বাঙালি বৃদ্ধাকে রয়েল লন্ডন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এহেন অযতœ-অবহেলার অভিযোগ উঠার পর বিভিন্ন কমিউনিটির আরো বেশ কিছু পরিবার একই অভিযোগ নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তারা দাবি করেছেন, এভাবে আরো অনেক ব্রিটিশ-বাংলাদেশী তথা এশিয়ান, কৃষ্ণাঙ্গ এবং মুসলিম পরিবারের বয়োবৃদ্ধরা ইতিপূর্বে রয়েল লন্ডন হাসপাতালসহ অন্যান্য নামকরা হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অযতœ-অবহেলার শিকার হয়েছেন। অন্য কমিউনিটির তুলনায় স্বাস্থ্যসেবায় উপরোক্ত কমিউনিটির লোকজন ইদানিং অত্যধিকহারে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। অথচ যুক্তরাজ্যের সর্বস্তরের নাগরিকদের মতো এসব অভিবাসী নাগরিকরাও সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বিধি অনুযায়ী সমহারে নিয়মিত কর পরিশোধ করে থাকেন। কিন্তু এসব অন্যায়ের ব্যাপারে নিয়মতান্ত্রিকভাবে অভিযোগ প্রদান বা প্রতিকার পাওয়া সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় অনেকে ক্ষুব্দ হলেও প্রশাসন বা মিডিয়ার সামনে নিয়ে আসতে পারেননি।
তবে বৃদ্ধা মাকে অযতœ-অবহেলা আর নিগ্রহ এবং এর জেরে পরবর্তীতে মায়ের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষুব্দ আব্দুল দয়াছ কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে বিষয়টি অবহিত করলে এর প্রতিবাদে সবাই সোচ্চার হন। ইতোমধ্যেই তারা সংবাদ সম্মেলন করে ‘প্যাশেন্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ইউকে’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। অযতœ-অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার, সদ্যপ্রয়াত জহুরা বিবির ছেলে, বিশিষ্ট কমিউনিটি নেতা, সমাজসেবী ও দানশীল ব্যক্তিত্ব আব্দুল দয়াছকে চেয়ারপার্সন, আরেক স্বনামধন্য কমিউনিটি নেতা সুরত মিয়াকে সেক্রেটারি এবং ইডেন কেয়ার ইউকে’র চেয়ারপার্সন আব্দুল মুনিম ও সাবেক কাউন্সিলর আবজল মিয়াকে ডিরেক্টর মনোনীত করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট এক্সিকিউটিভ কমিটির নাম ঘোষণা করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে বাঙালি কমিউনিটির নেতৃস্থানীয় এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ বিপুল সংখ্যক সিনিয়র সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, ‘নিকট অতীতেও আমাদের কমিউনিটির লোকজন এ ধরণের বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে আমাদের প্রবীণরা ভাষা সমস্যার কারণে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে পারেন না বিধায় তাঁরা নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকেন। অথচ বিধি অনুযায়ী রোগীর সহযোগিতার জন্য কোন আত্মীয়কে হাসপাতালে থাকতে দেয়া হয় না।’ বক্তব্যে তারা এসব বিধি-নিষেধ কিছুটা শিথিল করার দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘আব্দুল দয়াছের মায়ের প্রতি রয়েল লন্ডন হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অযতœ-অবহেলা আর অবজ্ঞার বিষয়ে ইতোমধ্যেই ব্রিটেনের মিনিস্ট্রি অব হেলথ্, স্থানীয় এমপি, লন্ডন সিটি মেয়র ও টাওয়ার হ্যামলেট সিটি মেয়র বরবারে অভিযোগ পেশ করা হয়েছে। একই সাথে ব্রিটিশ মেইনস্ট্রিম ও বাংলা ভাষাভাষী মিডিয়ায়ও তা তুলে ধরা হয়েছে।’ এতে আরো বলা হয়, ‘সম্প্রতি “প্যাশেন্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ইউকে” গঠনের পর বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তা প্রচার করা হলে, ইতিমধ্যেই কয়েক শ’ অভিযোগ জমা পড়েছে।’ সংবাদ সম্মেলন আয়োজকরা অভিবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সকলকে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানান।
এদিকে, প্যাশেন্ট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ইউকে গঠনের পর সংস্থার নেতৃবৃন্দ ইতোমধ্যেই রয়েল লন্ডন হসপিটালের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে দু’দফা বৈঠক করে কমিউনিটির রোগীদের যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে জোর প্রস্তাবাবনা তুলে ধরেন। হসপিটাল কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে সতর্ক এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস প্রদান করেছে।
যুক্তরাজ্যস্থ একটি সংবাদ মাধ্যম সুত্র জানিয়েছে, আব্দুল দয়াছের মায়ের প্রতি অযতœ-অবহেলার বিষয়ে এনএইচএস কর্তৃপক্ষের ভাষ্য জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত চলছে। সত্যতা পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’