এম এ মালেক : সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি, দৈনিক উত্তরপূর্ব পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের সিলেট প্রতিনিধি আজিজ আহমদ সেলিম আর নেই। রবিবার (১৮ অক্টোবর) রাত পৌনে নয়টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। তিনি করোনা ভাইরাসের কোভিড-১৯ আক্রান্ত ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার (৮ অক্টোবর) থেকে সিলেট সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন আজিজ আহমদ সেলিম। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ রাতে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও সদাহাস্যোজ্জ্বল এই সাংবাদিক। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৭ বছর। তিনি স্ত্রী, তিন মেয়েসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। সিলেট নগরীর মজুমদারী এলাকার বাসিন্দা ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে সিলেটের গণমাধ্যমকর্মীদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
আজিজ আহমদ সেলিমের জীবনী :
সিলেট অঞ্চলে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন তাদেরই একজন প্রয়াত আজিজ আহমদ সেলিম। পুরোনাম আবু উবায়েদ আজিজ আহমদ চৌধুরী। পিতা গোলাপগঞ্জ উপজেলার রণকেলী গ্রামের পশ্চিম বড়বাড়ীর অবসরপ্রাপ্ত অফিস সুপারিনটেনডেন্ট উবায়েদ আহমদ চৌধুরী। মাতা মেহেরুন নেসা চৌধুরী রীতা। আজিজ আহমদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৪ সালের ১২ মে সিলেট শহরের দরগাহ মহল্লায়। বর্তমানে মজুমদারিস্থ নিজস্ব বাসভবন রীতা কুঠিরের স্থায়ী বাসিন্দা। প্রাথমিক শিক্ষা সিলেট শহরের দূর্গাকুমার পাঠশালায় সম্পন্ন করে ১৯৬৬ সালে ‘দি এইডেড বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ে’ মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু করেন। ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের কারণে পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন তিনি। মুরারীচাঁদ কলেজ হতে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সাথে আই.এস.সি পাস করেন। একই বৎসর সরকারী কলেজে বোটানীতে স্নাতক পড়া শুরু করার পর ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনে ৭৬-এর গোড়ার দিকে তৎকালীন সরকারের হয়রানিমূলক কারণে বিদ্যাপীঠ পরিবর্তন করে মদন মোহন কলেজে বি.কম ক্লাশে ভর্তি হন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে না পারায় লেখাপড়াার এখানেই সমাপ্তি ঘটে।
আজিজ আহমদ সেলিম হাইস্কুলে অধ্যয়নকালেই ছাত্র রাজনীতি ও সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৭৬ পর্যন্ত ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে মুরারীচাদ কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেল হতে বিপুল ভোটে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। উক্ত নির্বাচনে ভিপি ছিলেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ (যিনি পরবর্তীতে ডাকসুর ভিপি ও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন, পরে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন)।
১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে মদন সিলেট মোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৭৬ ইং পর্যন্ত আজিজ আহমদ সেলিম সিলেট জেলা ছাত্রলীগের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও দপ্তর সম্পাদকের দায়িত পালন করেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সিলেটের নির্বাচনী সফরে আসলে এম.সি কলেজ ছাত্র সংসদের পক্ষে স্থানীয় সার্কিট হাউসে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হয় । ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদের নেতৃত্বে ছাত্র সংসদ প্রতিনিধি দলের পক্ষে দেয়া উক্ত স্মারকলিপি প্রদানকালে তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য। স্মারকলিপিতে এম.সি কলেজের উন্নয়নকল্পে আর্থিক সাহায্য চাওয়া হলে বঙ্গবন্ধু ১ লক্ষ টাকা অনুদান প্রদান করেন।
আজিজ আহমদ সেলিম ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে দি এইডেড বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যাগাজিন বার্ষিকীতে বলাকার ডানা’ কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে স্কুল ও কলেজ ম্যগাজিনেও ছড়া-কবিতা প্রকাশিত হয়। লেখালেখির জগতে পুরোপুরি বিকাশ ঘটে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সাপ্তাহিক যুগভেরীর শাপলার মেলার ছড়া- কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
পরবর্তীকালে পরোক্ষভাবে তিনি শাপলার মেলা’ বিভাগটি পরিচালনা করেন। তাঁর পরিচালনাকালে অনেক নবীণ লেখকের সৃষ্টি হয়। দেশ স্বাধীনের পর তিনি চাঁদের হাট, শাপলা শালুকের আসর, শিকড়, ভোরের আলো, সাহিত্য গোষ্ঠী, সিলেট সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ ইত্যাদি সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। তার সম্পাদিত সাহিত্য ম্যাগাজিনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : জন্মে সুখ, শাপলা ফড়িং, শিকড় প্রভৃতি। এ যাবত তাঁর ছড়া-কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ নিবন্ধসহ প্রায় দু’হাজারের অধিক লেখা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং সাময়িকীতে প্রকাশ লাভ করেছে।
তিনি ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ হতে বাংলাদেশ বেতার, সিলেট কেন্দ্রের একজন নিয়মিত কথক। তৎকালীণ সময়ে তিনি এ গ্রেড কথক হিসেবে সম্মানিত হন। ৯৭ এর এপ্রিল হতে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন, সিলেট প্রতিনিধির দায়িত পালন করে আসছিলেন। আজিজ আহমদ সেলিম ১৯৮৯-৯০ এবং ১৯৯১-৯২ খ্রিস্টাব্দ দু’দফায় সিলেট প্রেসক্লাবের কোষাধ্যক্ষ ১৯৯৩-৯৪ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ সম্পাদক, ১৯৯৭- ৯৮ খ্রিস্টাব্দে সিনিয়র সহ-সভাপতিরূপে নির্বাচিত হবার গৌরব অর্জন করেন। প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে তাঁর অকুণ্ঠ সহযোগিতায় সিলেট প্রেসক্লাব ভবনের দোতলা নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা হয় এবং আধুনিক রূপ লাভ করে। তিনি ১৯৮৯-৯১ খ্রিস্টাব্দে সিলেট সাংবাদিক ইউনিয়নের (এস.ইউ.জে) সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সিলেট ইউনিটের আজীবন সদস্য ছিলেন। প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু পরিষদ, সিলেট জেলা শাখা ও জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন, সিলেট জেলা শাখা। ১৯৯১-৯৩ খ্রিস্টাব্দে শিল্পকলা একাডেমী, সিলেট জেলা শাখার কার্যনির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। পরে সাধারণ সদস্য ছিলেন। তিনি ক্রীড়া লেখক সমিতি, সিলেট জেলা শাখার কোষাধ্যক্ষ ও সহ- সভাপতি হিসেবে দীর্ঘদিন যাবত দায়িত পালন করেন। একজন সাংবাদিকের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে ক্রীড়া সাংবাদিকতার মাধ্যমে ।
ক্রীড়া সাংবাদিকতায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে আজিজ আহমদ সেলিমও হয়ে উঠেন একজন পূর্ণাঙ্গ সাংবাদিক। তাঁর লেখা ক্রীড়া বিষয়ক অনেক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ দেশে বিদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং অভিজ্ঞ মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আজিজ আহমদ সেলিম ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ হতে “৮৮ পর্যন্ত একজন কৃতী ক্রিকেটার হিসেবে ঃ সিলেট প্রথম বিভাগ লীগে ইউনাইটেড ক্লাব, ভিক্টোরিয়া ক্লাব, জালালাবাদ ক্লাব, মোহামেডান স্পোটিং ক্লাব, অগ্রগামী ক্লাব, ইয়ং ভিক্টর ক্লাব, ইয়থ সেন্টার ক্লাব প্রভৃতির হয়ে খেলায় অংশগ্রহণ করেন।
১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ক্রিকেট আম্পায়ার পরীক্ষায় সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে এক বিরল সম্মাননা অর্জন করেন। তিনি একাধারে সিলেট এ খেলোয়ার সিলেকশন কমিটির সদস্য ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি সিলেট প্রথম বিভাগ ক্রিকেটলীগ পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবে দু’বার নিষ্ঠার সাথে দায়িত পালন করেন। একজন সহযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের এ স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। অনিবার্য কারণে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে না পারলেও ৭১ খ্রিস্টাব্দে (আগস্ট ৭১ হতে ডিসেম্বর ‘৭১ পর্যন্ত) আত্মগোপন করে থাকাকালীন সময়ে পাক বাহিনী ও তাদের দোসর আল বদর-রাজাকারদের গতিবিধি সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ করে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলমের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে খবর পৌছানোর কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
তাঁর সঠিক খবর ও দিক নির্দেশনার ভিত্তিতে অনেকগুলো ‘অপারেশন’ই সফলতা লাভ করেছিল। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মে হতে ২০ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পীকার আলহাজ্ব হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এমপির নেতৃত্বে একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রীয় সফরে গেলে যুগভেরীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আজিজ আহমদ সেলিম ঐ দলের সদস্য ছিলেন। লন্ডনে অবস্থানকালে টাওয়ার হেমলেটস কাউন্সিল এবং সেখানকার প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্র পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি সম্বর্ধিত হন। এর পূর্বে তিনি ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ব্যক্তিগতভাবে একবার প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত সফর করেন।
আজিজ আহমদ সেলিম সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করেন ১৯৭৬ খিস্টাব্দের ২০ ফেব্রুয়ারি। তৎকালীন সাপ্তাহিক যুগভেরীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ও স্টাফ রিপোর্টার গিয়াস উদ্দিন আউয়ালের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয়। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর প্রকাশিত বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সম্পাদক আমিনুর রশীদ চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে, নিয়োগপত্র প্রাপ্তি হয় সহজলভ্য এবং স্থায়ী। সেই থেকে প্রথমে স্টাফ রিপোর্টার ও পরে বার্তা সম্পাদক পদে বহাল ছিলেন দীর্ঘদিন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সাপ্তাহিক যুগভেরীর সম্পাদক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। পরবর্তীতে তিনি যুগভেরীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত পালন করেন।
দৈনিক যুগভেরী পর তিনি দৈনিক উত্তরপূর্বে প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত লাভ করেন, এ তিনি সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের দুই বারের নির্বাচিত সফল সভাপতি হিসেবে দায়িত পালনের পাশাপাশি বিটিভির সিলেট প্রতিনিধির দায়িত পালন করে আসছিলেন। সদালাপী, মিষ্টভাষী আজিজ আহমদ সেলিম ব্যক্তিগত জীবনে ৩ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে সবার বড়। বিবাহিত জীবনে তিনি স্ত্রী শাহরিন আজিজ চৌধুরী এবং সানিয়া আজিজ চৌধুরী, সাদিয়া আজিজ চৌধুরী ও সামিরা আজিজ চৌধুরী নামে ৩ কন্যা সন্তানের জনক। (তথ্য সূত্র-দৈনিক যুগভেরী)
লেখক এম এ মালেক- সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক সিলেট জেলা প্রেসক্লাব।