মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার :: তেতাল্লিশ বছরে পা রেখে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ দিয়েছে বিএনপি। ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে এ চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কিন্তু, কিভাবে কোন পথে এ চ্যালেঞ্জ জিতবে বা জিততে চায় বিএনপি?সেই ব্যাখ্যা বা কর্মপরিকল্পনার কথা পরিস্কার নয় তার বক্তব্যে।বারবার ক্ষমতায় আসা এবং টানা দফায় দফায় ক্ষমতার বাইরে থাকায় অভিজ্ঞ দলটির ভবিষ্যতই যেখানে চ্যালেঞ্জের মুখে,সেখানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মতো বিশাল চ্যালেঞ্জ জেতার স্বপ্নের রহস্য কর্মীদের কাছেও প্রশ্নবিদ্ধ-রহস্যঘন। এমন এক সময় তারা চ্যালেঞ্জটি দিয়েছে যখন দেশে আলোচনার অন্যতম বিষয় বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসার্থে বিদেশযাত্রা।
প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে বেগম খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত দেশের রাজনীতিতে নতুন ঘটনা। শর্তাধীনে মুক্তির পর এখন মুক্তির মেয়াদ বাড়াতে পরিবার থেকে সরকারের কাছে করা আবেদনও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্ববহ। বেগম খালেদা জিয়া আসলে বিদেশ যেতে চান কি-না? যাওয়ার সুযোগ পান কি-না? সরকার তাকে সেই সুযোগ দেবে কি-না? অথবা সরকারই তাকে যেতে বাধ্য করছে কি-না- এমন অনেক প্রশ্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে। এ নিয়ে গুঞ্জন-গুজব, আলোচনা-সমালোচনা, মূল্যায়নের ধুম যাচ্ছে। বলা হচ্ছিল চিকিৎসার নামে খালেদা জিয়াকে বিদেশ চলে যাওয়ার চাপ ছিল সেই ওয়ান ইলেভেন থেকেই।পরে এই চাপ অব্যাহত থাকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের শুরু থেকেও। কিন্তু, তিনি তাতে রাজি হননি। নানা ঘটনাপ্রবাহ শেষে গত ২৫শে মার্চ খালেদা জিয়া যখন মুক্ত হন তখনও সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া শর্তানুযায়ী কোনো সুযোগ ছিল না তার বিদেশ যাওয়ার। এবার আবেদনে ওই শর্ত শিথিলের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এর প্রেক্ষিত হিসেবে পরিবার ও বিএনপি নেতাদের যুক্তি হচ্ছে- উন্নত চিকিৎসার জন্য মুক্তি পেলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের হাসপাতালেও খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি। এর আগে, যুক্তরাজ্য এবং সৌদি আরবে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। দীর্ঘদিন তার সেই চিকিৎসার ফলো আপ হচ্ছে না। বাস্তবতা হচ্ছে,বিএনপির রাজনীতির ফিক্সড ডিপোজিট এর প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত সততা এবং সাড়ে তিন বছরের শাসনে দেশকে একটা স্থিতাবস্থা, কিছু সংস্কার ও উন্নয়নের নতুন যাত্রা শুরু করা। সেই ডিপোজিট এতো বছরে ফিক্সড নেই। অবশিষ্ট পুঁজি হচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। গৃহকোণ থেকে দলের নেতৃত্বে এসে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আপোসহীন বৈশিষ্ট্য এবং কয়েকদফায় দলকে ক্ষমতায় আনা।সেই বিবেচনায় তিনিই এখন দলের প্রাণভোমরা। দলের বর্তমান-ভবিষ্যতও তিনিই। স্বাভাবিকভাবেই তার সুস্থতা-অসুস্থতার সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির অস্বিত্ব বিদ্যমান। এটা বিএনপির রাজনীতির জন্য আরেক চ্যালেঞ্জ।
মূলত ওয়ান ইলেভেনের পর থেকেই চ্যালেঞ্জের পর চ্যালেঞ্জে ক্ষতবিক্ষত বিএনপি। আন্দোলনের চ্যালেঞ্জে মার খেয়েছে বিরতিহীনভাবে। পরিণামে টানা তিন দফায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ধারেকাছেও ঘেঁষতে না পারা। সাংগঠনিক দুর্বলতার পাশাপাশি মামলা ও গ্রেফতারসহ সরকারের নিপীড়নে নাজেহাল দশা নেতাকর্মীদের। মুক্ত হয়েও নানা কারণে সক্রিয় নন খোদ দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশান্তরি। গণতন্ত্র ফেরানোর চ্যালেঞ্জের চেয়ে দলের এই করুণ সংকট কাটানো বিএনপির জন্য আরো জরুরি চ্যালেঞ্জ। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর নানা ঘটনাপ্রবাহের এক পর্যায়ে ফোকাসে আসেন সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান। সেনাপ্রধান হন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ৭ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের পর নাটকীয় পরিস্থিতে তিনি চলে আসেন শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রে। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি হন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। ১৯৭৭ এর ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে যেতে হয়, জিয়া তখন ওই দায়িত্বও নেন। সে সময় জিয়ার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টায় একটি গণভোট হয়। ৯৮.৯ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোটে জয়ী হন তিনি। সামরিক আইন প্রশাসক থাকা অবস্থায় জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গড়ে ওঠে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল-জাগদল।
কিছুদিন পর ওই বছর ১ মে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ ঘোষণা করা হয়। ৩ জুন নির্বাচন দিয়ে ওই ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ থেকে প্রার্থী হয়ে তিনি ‘নির্বাচিত’ রাষ্ট্রপতি হন। নির্বাচনের তিন মাসের মাথায় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। জাগদল, মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বাধীন ন্যাপ, আবদুল হালিম-আকবর হোসেনের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, আব্দুল মতিনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি ও শাহ আজিজুর রহমানের মুসলিম লীগ বিলীন হয় জিয়ার বিএনপিতে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হলেও বিএনপি ক্ষমতাচ্যুত হয়নি। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার এক বছরের মধ্যে রাজনীতিতে নেমেই দলের ভাইস চেয়ারম্যান পদ নেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তখন বিএনপির চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার।
জিয়ার বিশ্বস্ত সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ ১৯৮২ সালে বিএনপি হটিয়ে ক্ষমতা দখল করলে সাত্তারের অসুস্থতার মধ্যে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের পদ নিয়ে দলের হাল ধরেন খালেদা জিয়া। তারপর ১৯৮৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন তিনি। সেই থেকে বেগম জিয়া এই পদে আসীন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার পর দুই বার তার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বিএনপি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর থেকে টানা ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। দফায় দফায় আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা ও চেষ্টা করেও বিফল। বরং আরো খাদেই পড়তে থাকে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে জিয়া অরফানেজ মামলার সাজায় কারাগারে যেতে হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয় এক যুগ ধরে লন্ডন অবস্থানকারী ছেলে তারেক রহমানকে।
এর মধ্যে দেশে তিনটি মামলায় তাঁর সাজার রায় এসেছে । খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি । গত ২৫ মার্চ ২০২০ সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পাওয়ার পর থেকে নিজের বাসাতেই আছেন খালেদা জিয়া।
এর মাঝেই তাঁর দন্ড স্থগিতের মেয়াদ বাড়াতে সরকারের কাছে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। কিছুটা মিরাকল হচ্ছে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ না থাকা এবং অসংগঠিত নেতৃত্বের মধ্যেও নেতাকর্মীরা নেতিয়ে পড়লেও হাল ছাড়েনি । প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সময়ে বিপর্যয়ে পড়ে দলটি । কিন্তু বারবারই তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে । কিন্তু, এবার কিভাবে ঘুরে দাঁড়াবে তা প্রশ্ন হয়েই থাকছে । বিদ্যমান রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ কতোটা আছে, কিভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা আসবে-? – এ প্রশ্নকে গুরুত্ব দিয়েই চ্যালেঞ্জ জয়ের কাজটা অন্তত শুরু করার পরামর্শ বিএনপির হিতাকাঙ্ক্ষীদের।
লেখকঃ নির্বাহী সম্পাদক দৈনিক আপন আলো _| বিশেষ প্রতিবেদক শ্যামল বাংলা ডট নেট _| সাবেক কাউন্সিলর- বিএফইউজে-বাংলাদেশ _| সদস্য ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ( ডিইউজে -)