• ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২২শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এমন কলঙ্কজনক নির্বাচন আগে আর হয়নি

sylhetsurma.com
প্রকাশিত জানুয়ারি ১৭, ২০১৯
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এমন কলঙ্কজনক নির্বাচন আগে আর হয়নি

রুবেল আহমেদ :
গত ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। মোট ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করেছে। এর মধ্যে শরিক দল জাতীয় পার্টির জয় ২০টিতে। বিএনপি পেয়েছে পাঁচটি, গণফোরামের দু’টিসহ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের আসন সংখ্যা মাত্র সাতে দাঁড়িয়েছে। সব ভবিষ্যদ্বাণীকে ছাপিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট এখন ‘একাকার’। যারা আওয়ামী লীগ শাসনামলের সমালোচনা করতেন, এখন তারাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ২০১৪ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না বলেছিল। পক্ষান্তরে এতদিন যত কথাই বলুক না কেন, ২০১৮ সালে বলেছে যে, কোনো প্রতিকুল অবস্থায়ই নির্বাচনের মাঠ থেকে সড়ে দাঁড়াবে না। এই দু’টি কথাই বিএনপি রেখেছে। সাংগঠনিক বিষয়সহ দলীয় নেতাকর্মীদের সঠিক মূল্যায়নের প্রশ্নে বিএনপির অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা রয়েছে অথবা দলটির শাসনামল সম্পর্কে অনেক কথা থাকতে পারে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতির কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি প্রশ্নে বিএনপি বিচ্যুতি ঘটায়নি।
নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট সাত দফা দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেছে, যার একটিও তিনি গ্রহণ করেননি। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত ছিল, গায়েবি মামলার অবসান। সংলাপের টেবিলে প্রশ্নটি উপস্থাপিত হলে বিএনপি মহাসচিবের কাছে প্রধানমন্ত্রী কৌশলে মামলার একটি তালিকা চেয়েছিলেন। বিএনপি মহাসচিবের কৌশল অবলম্বন করে বলা উচিত ছিল, তালিকা তো আপনার দফতরে আছে, কারণ সরকারের নির্বাহী প্রধানের সম্মতি বা নির্দেশ ছাড়া পুলিশ একক সিদ্ধান্তে দেশের প্রতি থানায় বিএনপির বিরুদ্ধে একই ধারায় একই ধরনের অসংখ্য মামলা দেবে, তা বিশ্বাস করা যায় না। বাংলাদেশের যেকোনো দফতর প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন এবং তার সম্মতি বা অনুমোদন ব্যতীত কোনো বড় সিদ্ধান্ত বা কাজ করার এখতিয়ার পুলিশ কেন, সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানেরও বাস্তবে নেই। কৌশলকে কৌশল দিয়ে আটকাতে হয়।
তবে গায়েবি মামলার প্রশ্নে বিরোধী দল কৌশল ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই মামলা সম্পর্কে তালিকা দেয়ার কথা স্বীকার না করে উল্টো প্রধানমন্ত্রীর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে কৌশলকে কৌশল দিয়ে মোকাবেলা করা উচিত ছিল। অথবা সবিনয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বলা যেত, বিএনপির কার বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা আপনি (প্রধানমন্ত্রী) দেননি, তার একটি তালিকা প্রকাশ করলেও গায়েবি মামলার সঠিক চিত্র পেয়ে যাবেন। হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলে, লাখ লাখ নেতাকর্মী গায়েবি মামলার আসামি ও বাড়িছাড়া। ঐক্যফ্রন্ট আশায় ছিল, জনগণ মাঠে নামবে এবং কাংক্ষিত ফসল ঘরে আসবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার খুবই জোরগলায় বলেছিলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর কোনো মামলা হবে না বা গ্রেফতার করা হবে না। তারপরও প্রতিদিনই মামলা হয়েছে এবং গ্রেফতারও করা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের আগ মুহূর্তে পুলিশপ্রধানের সাথে সুর মিলিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার গায়েবি মামলাকে জায়েজ করার জন্য বলেছিলেন, ফৌজদারি মামলা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার না করার জন্য পুলিশকে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই নির্দেশকে পাকাপোক্ত করলেন পুলিশ প্রধান এ কথা বলে যে, ফৌজদারি মামলার আসামিদের গ্রেফতার করা হবে। ফলে কথাটির মানে দাঁড়াল, গায়েবি মামলার আসামিদের গ্রেফতার করা যাবে।
উল্লেখ্য, বিএনপি নেতাকর্মী-সমর্থকদের গায়েবি মামলার আসামি করা হয়েছে এবং যাদের আসামি করা হয়নি, নির্বাচনের আগে সাদা পোশাক ও পোশাকি পুলিশ বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি করেছে এবং আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা পুলিশের ছত্রছায়ায় বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি ও ভাঙচুর করেছে। বিএনপি প্রার্থীদের নিরাপত্তার জন্য নির্বাচন কমিশন কার্যত কোনো ভূমিকা গ্রহণ করেনি। বিএনপির ভোটার দেখলে তাদের ভোট দিতে দেয়া হয়নি, ব্যালট পেপার রেখে নিজেরাই নৌকা মার্কায় সিল মেরেছে। আগের রাতেই ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে করা হয়েছিল। বিএনপি প্রার্থীদের ওপর সরকারি দলের হামলার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কোনো প্রতিকার করেনি, বরং এটাকে উৎসাহিত করেছে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা বলে। ‘বিচ্ছিন্ন’ শব্দটি নির্বাচন কমিশনের সৃষ্টি শুধু ক্ষমতাসীন দল ও সরকারি বাহিনীর তা-বকে বৈধ করার জন্য। এ জন্যই কবির ভাষায় বলতে হয়- ‘যারা অন্ধ আজ চোখে বেশি দেখে তারা’। অর্থাৎ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নাকি সুষ্ঠু হয়েছে।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বিএনপির ঘরে সফলতার সাথে সরকার অজস্র মামলা ঢুকিয়ে দিয়েছে, যাতে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করে কারাগার ভর্তি করা যায়। মামলা গায়েবি অর্থাৎ সাজানো জেনেও ম্যাজিস্ট্র্রেট ও জেলা জজ জামিন না দিয়ে গায়েবি মামলাকে বৈধ করেছেন।
এমতাবস্থায়, পুলিশ প্রধান ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য- ফৌজদারি মামলার আসামিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে (পুলিশ প্রধান) এবং ফৌজদারি মামলার আসামি ছাড়া কাউকে গ্রেফতার না করার জন্য কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে (সিইসি)। এসব বক্তব্যে একদিকে গায়েবি মামলাকে বৈধ করা হয়েছে, অন্য দিকে বিএনপি সমর্থকদের গ্রেফতার করার জন্য অফিসিয়ালি উৎসাহিত করা এবং নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
বিএনপির নেতাকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা সত্ত্বেও সরকারি প্রচারযন্ত্রের বদৌলতে ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’ দল হিসেবে অভিহিত হয়েছে সরকারি প্রচারকদের দ্বারা। অথচ বিপরীতে, বিএনপি মালিকানাধীন মিডিয়া এ মর্মে কার্যত কোনো ভূমিকাই রাখেনি। বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবীরাও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি, মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া। কলকাতামনস্ক বুদ্ধিজীবীরা শহীদ জিয়ার নামে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত নানা কলঙ্ক আরোপ করেছেন।
এ মর্মে রাজনৈতিক আন্দোলন ও সাংগঠনিক তৎপরতা, জনগণের প্রবল ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা, বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের নির্বিচারে গণহত্যা প্রভৃতি এ মেজর জিয়ার ঘোষণার বিষয়ে শক্তি জোগান দিয়েছে। তারপরও সরকারি প্রচারে এবং কথিত বুদ্ধিজীবীদের মতে জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি হয়ে গেল ‘স্বাধীনতাবিরোধী’। এটাই ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। জোট করে বিএনপি ভোট ও আন্দোলন-সংগ্রামে কতটুকু সহযোগিতা পেয়েছে তা অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে। পাশাপাশি, ঐক্যফ্রন্ট বিএনপির ধানের শীষ নিয়েছে, পক্ষান্তরে বিএনপিকে দিয়েছে কতটুকু তাও পর্যালোচনার বিষয়।
বাংলাদেশে বাম ও ইসলামী দলগুলো ঐকমত্যে আসতে পারেনি। বাম দলগুলো যদিও কদাচিৎ কোনো কোনো প্রশ্নে একমত হয়, কিন্তু ইসলামী দলগুলো ঐক্যের প্রশ্নে একেবারেই বিমুখ। ইসলামী দলগুলো যদি একক নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে পারত, তবে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ধর্না দিতে হতো না। ইসলামী শক্তির ঐক্যহীনতার কারণে বড় বড় দলগুলো কর্তৃত্ব দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে।
বিএনপি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ধারণা ছিল, পক্ষপাতিত্বমূলক নির্বাচন কমিশন ও মারমুখী পুলিশ বাহিনীকে উপেক্ষা করেই জনগণ ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়াবে। কিন্তু কাক্সিক্ষত অবস্থা অর্থাৎ গণবিস্ফোরণ কেন সৃষ্টি হলো না তাও খুঁজতে বিএনপিকে আরো গভীরে যেতে হবে। এ কারণটি খুঁজে বের করতে না পারলে হাঁটতে হবে অনেক দূর পর্যন্ত, সে হাঁটা নোনা পানির বালুচরে নয়, বরং কাঁটা বিছানো পথে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ৮০ শতাংশ ভোটার এবার ভোটে অংশগ্রহণ করেছেন বিধায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। অন্য দিকে, অন্যতম নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, নিজের বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হয়েছে। বিবেক কি আছে, না বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে, তা এখন প্রধান ইস্যু হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিবেক কতটুকু কাজ করছে, তা তিনি নিজেই বলতে পারবেন কি না সন্দেহ। তবে তিনি যদি ছদ্মবেশে গ্রামগঞ্জে হেঁটে গণমানুষের সাথে আলাপ করতেন, তবে ভোটের আগের রাতসহ ভোটের দিন পুলিশ, কমিশন, সরকারি দলের কর্মকা- সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারতেন।
কল্পনাতীতভাবে পরাজয়সহ শত প্রতিকুলতার মধ্যেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে দু’টি বিষয়ে বিএনপি লাভবান হয়েছে। যথা- ০১. প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যারা একসময় সরকারি ঘরানার নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ধানের শীষের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ এবং ০২. ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রমাণ করে, দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।
যেকোনো উপায়ে জয়ী হতে পারলে কোনো দোষ নেই। কিন্তু রাজনীতিতে হেরে যাওয়া বা পরাজয় বরণ করাটাই ভুল। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন থেকে সরে সহায়ক সরকার বা নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি বা রূপরেখা দেয়ার বক্তব্য বিএনপির অন্যতম ভুল ছিল। সবকিছু পর্যালোচনার পর এটাই সত্য, যেকোনো দলীয় সরকারের অধীনে ঔপনিবেশিক শিক্ষায় দীক্ষিত পুলিশ/প্রশাসনের মাধ্যমে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। ক্ষমতা রদবদলের প্রশ্নে পুলিশ/প্রশাসনের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা কি যুক্তিসঙ্গত?
লেখক : কলামিস্ট, প্রবাসী।