শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পারের মানুষের ভাগ্যাকাশে এখন দুশ্চিন্তার মেঘ। নদীর তলদেশ থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালি ও মাটি উত্তোলনের ফলে দেখা দিয়েছে ভাঙনের শঙ্কা।
অপরিকল্পিত এবং অবৈধ পন্থায়।
কালীগঞ্জ পৌরসভা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ আলমের নেতৃত্বে দিন-রাত চলছে শীতলক্ষ্যার এসব বালি-মাটি উত্তোলনের কাজ। স্থানীয় চেয়ারম্যান, গণ্যমান্য ব্যক্তি, এমনকি প্রশাসনের নিষেধও উপেক্ষা করে চলেছে অবৈধ মাটি কাটার মহোৎসব।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এভাবে অবৈধ এবং অপরিকল্পিতভাবে নদীর তলদেশ থেকে বালি এবং মাটি কেটে নিলে ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশও বিপন্ন হয়ে উঠবে। নদীর মাছ, জলজ উদ্ভিদ এবং পরিবেশগত ক্ষতি হবে ভয়াবহ পরিমাণে। পাশাপাশি নদীর পার্শ্ববর্তী জনজীবনের জন্যও তা হুমকিস্বরূপ হয়ে ওঠে।
সরেজমিনে দেখা যায়, শীতলক্ষ্যা নদীর কালীগঞ্জ এবং পলাশ এলাকার মানুষের মনে এখন সবচেয়ে বড় আতঙ্ক এই মাটি কাটার ঘটনা। যার নেতৃত্বে কাজটি চলছে, তিনি স্থানীয় কালীগঞ্জ ছাত্রলীগের সভাপতি। এ জন্য মুখ খুলে ক্ষতির আশঙ্কায় থাকা সাধারণ মানুষ কিছু বলতেও পারে না।
একাধিকবার প্রশাসনের অভিযানও ব্যর্থ হয়েছে। বৃথা গেছে স্থানীয় চেয়ারম্যানের মৌখিক নিষেধাজ্ঞাও। এলাকাবাসীর চোখেমুখে তাই এখন চরম হতাশা।
সরেজমিনে আরো দেখা যায়, নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের সান্তানপাড়ার পাশে একযোগে পাঁচটি ড্রেজার চালিয়ে নদীর তলদেশ থেকে মাটি কেটে আনা হচ্ছে। এসব মাটি চলে যাচ্ছে পূর্বনির্ধারিত গন্তব্যে। সকাল থেকে রাত অবধি, একটি মিনিটের জন্যও ড্রেজারগুলো বন্ধ থাকছে না। কালীগঞ্জ ছাত্রলীগ সভাপতি শাহ আলম মাঝেমধ্যে এসে ঘুরে দেখেন নির্বিঘ্নে কাজ চলছে কিনা। মূলত নিজের রাজনৈতিক পদবির বলয়েই অবৈধ হলেও তিনি কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন বলে স্থানীয়রা জানান।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রশাসন বহুবার এখানে অভিযান চালিয়েছে। মাটি কাটতে নিষেধও করে গেছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা জারির পরদিনই ফের শুরু হয় মাটিকাটা। যেখানে তারা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞাই মানছে না, সেখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের কিছুই বলার থাকে না।
খবর নিয়ে জানা গেছে, ডাঙ্গা ইউনিয়নে গড়ে ওঠার কথা এ কে খান গ্রুপের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। সরকার ইতিমধ্যে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদনও দিয়েছে। দেশের তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান কমলিংক ইনফো টেক এখানে হাইটেক পার্ক গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাণ গ্রুপের কয়েকটি শিল্প কারখানা রয়েছে। যেখানে শত শত শ্রমিক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কিন্তু অবৈধ ও অপরিকল্পিতভাবে নদীর তলদেশ থেকে মাটি কেটে নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত যে ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তাতে এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছে। এতে নরসিংদীর এলাকাটি বিপুল সম্ভাবনার হাতছানি সত্ত্বেও তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
শিল্প কারখানার মালিক এবং কর্তৃপক্ষের লোকজন বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে মাটি উত্তোলনের কারণে যেকোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে, নদীর অনেকাংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
ডাঙ্গা ইউনিয়নের মহিউদ্দিন, মাসুম বিল্লাহ, জাফর আহম্মেদ, করিমুল হক জানান, শীতলক্ষ্যার পারে বসবাস করে আসছি বহু বছর ধরে। অনেক ঝড় তুফান আসলেও কোনো রকম বিপদ হয়নি। কোনো আশঙ্কাও করি না। কিন্তু এখন যে ঝড় আসতে শুরু করেছে, তাতে শঙ্কিত না হয়ে পারি না। তলদেশ থেকে মাটি কেটে নেওয়ায় নদীর পার ভাঙতে শুরু করবে। একবার ভাঙন দেখা দিলে গোটা এলাকা ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন আর কেউই এখানে থাকতে পারবে না। পরিবার পরিজন নিয়ে পথে বসে যেতে হবে সবাইকে।
স্থানীয় ডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাবেরুল হক হাই এ প্রসঙ্গে জানান, আমরা অনেকবার স্থানীয়ভাবে ব্যবস্থা নিয়েছি। ড্রেজারগুলো প্রশাসন জব্দও করেছে। কিন্তু ওরা অভিযানের পর আবারও ড্রেজার নামিয়ে মাটি কাটে। আমরা কতদিন পাহারা দিতে পারব। ওদের কোনোভাবেই এখান থেকে সরানো যাচ্ছে না।
চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘এভাবে মাটি কাটার ঘটনা অব্যাহত থাকলে আমার ইউনিয়নের বহু পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসবে। এ ছাড়া পরিবেশেরও ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে। তাই এদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ‘
অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা শাহ আলমের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
kalerkantho.com