বিশেষ প্রতিবেদন: নিজেদের এক কর্মী খুনের ঘটনায় সিলেটে জেলা ছাত্রলীগের কমিটি সম্প্রতি বিলুপ্ত করেছে কেন্দ্র। আর নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে নগর ছাত্রদলের কমিটি সাত মাস আগে বাতিল হয়। এই অবস্থায় নেতৃত্ব নিয়ে সিলেটে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল একই ধরনের সংকটে আছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা।
ছাত্রলীগের নেতৃত্ব বাছাইয়ে চাই আওয়ামী লীগের সম্পৃক্তকরণ
২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শাহরিয়ার সামাদকে সভাপতি এবং এম রায়হান চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে ১০ সদস্যের জেলা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। ২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর আরও ১৩১ সদস্য অন্তর্ভুক্ত করে গঠিত ১৪১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে চলছিল সাংগঠনিক কার্যক্রম। এ কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় এলাকাভিত্তিক ‘গ্রুপ’ সৃষ্টি হয়। কার্যত ছয় টুকরা ছিল জেলা ছাত্রলীগ। এই অবস্থায় গত ১৬ অক্টোবর টিলাগড় এলাকায় জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রায়হান চৌধুরীর পক্ষের কর্মীদের হাতে প্রতিপক্ষের (জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি কিরণ মাহমুদের) কর্মী ওমর মিয়াদ (২২) নিহত হন বলে অভিযোগ ওঠে।
হত্যা মামলায় রায়হান চৌধুরী অভিযুক্ত হওয়ার পর জেলা ছাত্রলীগের কমিটি ১৮ অক্টোবর বিলুপ্ত করা হয়। নতুন কমিটির জন্য সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ পেতে আগ্রহীদের জীবনবৃত্তান্ত জমা দিতে বলেছে কেন্দ্র। ছাত্র-অছাত্র মিলিয়ে ৩০০টি জীবনবৃত্তান্ত জমা পড়েছে। অন্যদিকে নগর ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ চার সদস্যের কমিটি কেন্দ্র থেকে ২০১৫ সালের ২০ জুলাই ঘোষণা করা হয়। প্রায় দুই বছর গেলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি আজও হয়নি।
ছাত্রলীগের এই অবস্থাকে নতুন নেতৃত্ব বাছাইয়ের সংকট বলে মনে করেন নব্বইয়ের দশকে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা নাসির উদ্দিন খান। গত মঙ্গলবার তাঁর সঙ্গে কথা হয়। নব্বইয়ের দশকটি ছাত্রলীগের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দল তখন ক্ষমতায় ছিল না।
সেই কঠিন সময়কে আমরা সাংগঠনিক তৎপরতা দিয়ে জয় করেছিলাম বলে সিলেটে ছাত্রলীগ এখনো আছে। তখন ছাত্রলীগের হাল ধরবে কে—এমন পরিস্থিতিতে মূল দল তথা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা পর্যন্ত বিচলিত ছিলেন। পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের পর্যবেক্ষণ ও স্থানীয় নেতাদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ নতুন নেতৃত্ব পেয়েছিল।’
সিলেট ছাত্রলীগের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদউদ্দিন আহমদও। সিলেটের মদন মোহন কলেজ ছাত্র সংসদে ছাত্রলীগের জিএস ও ভিপি ছিলেন তিনি। সাবেক এই ছাত্রনেতা মনে করেন, বর্তমানে কেন্দ্র গণহারে জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে নেতৃত্ব বাছাই করে, যা সঠিক পন্থা নয়। তিনি বলেন, ‘জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়ে নেতা নির্বাচিত হবে কেন? নেতা নির্বাচিত হবে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসভিত্তিক সাংগঠনিক তৎপরতা দেখে। এটা না হওয়ায় নেতৃত্ব টেকসই হচ্ছে না।’
ছাত্রদলে চাই আন্দোলনে সক্রিয় তরুণ নেতৃত্ব
২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর নুরুল আলম সিদ্দিকীকে সিলেট নগরের সভাপতি ও সাঈদ আহমদকে জেলার সভাপতি করে ছাত্রদলের আট সদস্যের কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ওই কমিটি বর্ধিত করে ৭৬২ সদস্যবিশিষ্ট করা হয়। পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার পরও সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটাতে নেতৃত্ব প্রায় ব্যর্থ হন বলে অভিযোগ ছিল। এই অবস্থায়গত ৪ এপ্রিল নগর কমিটি বাতিল হয়। কমিটি বাতিলের পর নগর ছাত্রলীগের সভাপতি বিদেশে চলে গেছেন। সদ্য সাবেক অন্য নেতারাও আর সাংগঠনিক তৎপরতায় নেই। ফলে নগর ছাত্রদল গত প্রায় সাত মাস কোনো কমিটি ছাড়াই চলছে। অন্যদিকে জেলা ছাত্রদলের কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ।
এমন পরিস্থিতিতে সিলেটে ছাত্রদল একধরনের সংকটকাল অতিবাহিত করছে বলে মনে করেন জিয়াউল গণি আরেফিন। ছাত্রদলের বর্তমান অবস্থা নিয়ে গত বুধবার খোলামেলা কথা হয় বিগত চারদলীয় জোট সরকার আমলের পাশাপাশি এক-এগারোর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নগর ছাত্রদলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা এ নেতার সঙ্গে। বর্তমানে মহানগর বিএনপির সহসভাপতি তিনি।
সার্বিক অবস্থায় হতাশা এখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে মন্তব্য করে জিয়াউল বলেন, ‘সিলেটে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে সবচেয়ে বড় ছাত্রসংগঠনে রূপ পেয়েছিল আমাদের সময়েই। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় ও কমিটি গঠনে সাবেক ছাত্রদল নেতাদের মতামত প্রাধান্য না দেওয়ায় ছাত্রদল ছত্রভঙ্গ অবস্থায় আছে। সাংগঠনিক তৎপরতা না থাকায় সাধারণ কর্মীরাও কোণঠাসা।’
এই অবস্থায় করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্র যদি উদ্যোগী হয়, তাহলে ছাত্রদলকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এ মুহূর্তে প্রয়োজনতারুণ্যনির্ভর নেতৃত্ব। কমিটি ভেঙে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করতে হবে। এতে মূল দল অথবা ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে।’
নগর বিএনপির সহসভাপতি সালেহ আহমদবলেন,মহানগর কমিটি নেই। জেলা কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ। এই অবস্থায় ছাত্রদল মোটেও সুশৃঙ্খল অবস্থায় নেই। এই অবস্থা কাটাতে ছাত্রদলকে অবশ্যই রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় তরুণ নেতৃত্বনির্ভর হতে হবে। এমনটি হলে আর ছাত্রদলের খণ্ডবিখণ্ড মিছিল দেখতে হতো না।
সালেহ আহমদ বলেন, ছাত্রদলের সবাই একীভূত হয়ে রাজপথে নামলে সিলেটে এ ছাত্রসংগঠনকে বৃহৎ রূপে দেখা যাবে। সেটি হলে ছাত্রদলকে দেখে বিএনপিও উজ্জীবিত হবে।