• ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৯শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

পুলিশ-সাংবাদিক: সম্পর্কটা হোক ভালোবাসার

sylhetsurma.com
প্রকাশিত অক্টোবর ১৯, ২০১৭

প্রভাষ আমিন:-  ঢাকাসহ সারাদেশের হলে হলে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ নিয়ে তোলপাড়। পুলিশের অবদানের জয়জয়কার। ঠিক তখনই ঢাকার রাজপথে পুলিশের হাতে নাজেহাল হলো আরও এক সাংবাদিক। গত ১২ অক্টোবর এই ঘটনার পর আমি ফেসবুকে নিচের স্ট্যাটাস দেই। ‘সবাই মনে করে সাংবাদিক মানেই সাংঘাতিক, তাদের ক্ষমতার শেষ নেই, টাকারও শেষ নেই। কিন্তু দেখুন মানবজমিনের ফটোসাংবাদিক নাসিরউদ্দিন কত অসহায়। তিনদিন আগে তার হেলমেট হারিয়েছে। আমি জানি হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো বেআইনি এবং চালকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ট্রাফিক সার্জেন্ট মুস্তাইন তাকে সঠিকভাবেই আটকেছেন।

নাসিরউদ্দিন বলেছেন, বেতন পেলেই হেলমেট কিনে নেবেন। কিন্তু মুস্তাইন হয়তো বিশ্বাসই করেননি যে নাসিরউদ্দিন বেতনের অভাবে হেলমেট কিনতে পারছেন না। মুস্তাইন ধরেছেন, তিনি মামলা দিতে পারতেন। কিন্তু গায়ে হাত তুললেন কেন? সাংবাদিক কেন, কোনো মানুষের গায়ে হাত তোলার অধিকার কারো নেই। এর বিচার চাই।’

এই স্ট্যাটাস অনেকেই মন্তব্য করেছেন। সেখানে কেউ পুলিশের পক্ষে বলেছেন, কেউ সাংবাদিকদের সমালোচনা করেছেন। সেইসব মন্তব্যে কিছু যৌক্তিক প্রশ্ন ছিল। সেসব নিয়েই এই লেখা।

অনেকে বলেছেন, সাংবাদিক বলেই আমি সাংবাদিকের পক্ষ নিয়েছি। এই জায়গাটা পরিষ্কার করা দরকার। আমি কখনও ব্যক্তি বা পেশার পক্ষ নেই না। আমার অবস্থান বরাবরই ন্যায়ের পক্ষে। আমার কাছে যদি মনে হতো, এখানে সাংবাদিক দোষী, তাহলে আমি অবশ্যই পুলিশের পক্ষ নিতাম। পুরো ঘটনার খুটিনাটি আমি জানি না। ফেসবুকে যে ছবিগুলো দেখেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে, পুলিশ সার্জেন্ট মুস্তাইন এখানে আইন হাতে তুলে নিয়েছেন। তাই আমি তার বিচার চেয়েছি। ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান শেষে যদি সাংবাদিক নাসিরউদ্দিনের কোনও অন্যায় পাওয়া যায়, শাস্তি চাই তারও।

গত ৩০ বছর ধরে আমি ঢাকার রাস্তা চষে বেড়াই। গত ১২ বছর ধরে গাড়ি চালাই। পেশার কারণেই ঢাকার প্রায় সব আনাচে-কানাচে ঘুরেছি। রাজপথে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন দায়িত্ব পালন করেছি। পেশাগত কারণে পুলিশি হয়রানির শিকার হয়েছি। পুলিশের টিয়ার গ্যাস খেয়েছি অনেক। পুলিশের লাঠির বাড়িতে মাথা ফেটেছে। তাই আমি ঢাকার রাস্তার অবস্থাটা অন্য অনেকের চেয়ে ভালো করে জানি। ঢাকার রাস্তায় দায়িত্ব পালন করা পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের ধৈর্য দেখে অবাক হয়ে যাই। আমি নিজেকে অনেক ধৈর্যশীল দাবি করি। কিন্তু ঢাকার পুলিশের কাছে আমার ধৈর্য নস্যি। সারাক্ষণ আমরা ট্রাফিক আইন ভাঙার ছুতো খুঁজি, চান্স পেলেই উল্টো পথে গাড়ি চালাই, ট্রাফিকদের ধমকাই।

তাদের জায়গায় থাকলে আমি অত ধৈর্য রাখতে পারতাম কিনা জানি না। তারা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের কাজের সময় অনেক বেশি, ছুটি অনেক কম। দিনের পর দিন তারা পরিবার স্বজনদের কাছ থেকে দূরে থাকেন। পুলিশরাও মানুষ। তারা প্রায়ই মেজাজ হারান। উল্টোপথে যাওয়া মন্ত্রী-এমপিদের বড় বড় গাড়ি আটকাতে না পারলেও (যদিও মাঝে মাঝে ওনারা আটকানোর চেষ্টা করেন) তারা রিকশাওয়ালা, সিএনজিওয়ালাদের সঙ্গে রাগ ঝাড়েন। কখনও কখনও অন্যায়ভাবে দুর্বল চালক পেলে মামলা করেন।

মাঝে মাঝে হাতও তোলেন। যখন কোনও সাংবাদিক হেনস্থার শিকার হন, তখনই সেটা নিয়ে অনেক হইচই হয়। অভিযুক্ত পুলিশ ক্লোজ হন, কখনও কখনও বরখাস্তও হন। কিন্তু পুলিশের শত সীমাবদ্ধতা মেনে, তাদের প্রতি সম্পূর্ণ সহানুভূতি রেখেও বলছি, আইন হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। আপনার দায়িত্ব বেশি মানে আপনার ধৈর্যও বেশি হতে হবে। আপনার হাতে আইন আছে, আপনার হাতে অস্ত্র আছে। তাই আপনাকে আমাদের মতো আমজনতার মানের ধৈর্য নিয়ে রাস্তায় নামলে হবে না। আপনার নার্ভ হতে হবে ইস্পাতের মতো। কারণ পুলিশ প্রশিক্ষিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

পুলিশের হাতে যেহেতু অস্ত্র আছে, তাই তাদেরকে বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে, অনেক বেশি ধৈর্য ধরতে হবে। একই কথা প্রযোজ্য সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেও। কারণ তাদের হাতেও কলম আছে। অস্ত্র হিসেবে কলমের ধার পুলিশের অস্ত্রের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। সাংবাদিকদের কেউ কেউ এই অস্ত্রের ধারটা জানেন এবং তার অপপ্রয়োগ করেন। সব পুলিশ যেমন খারাপ নয়, তেমনি সব সাংবাদিকও ভালো নয়। অনেক সাংবাদিক আছেন, যারা রাস্তায় নামলে আইন-কানুনের তোয়াক্কা করেন না। হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো, নাম্বার প্লেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো, উল্টো পথে গাড়ি চালানো, যেখানে সেখানে পার্ক করে রাখা- সাংবাদিকরা এমন ঘটনা অহরহই ঘটান।

রাস্তায় দায়িত্ব পালন করা কনস্টেবল বা সার্জেন্টের সাধ্য থাকে না তাদের আটকানোর। কারণ সাংবাদিকরা হয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফোন করেন বা সহকর্মীদের ফোন করে জটলা করেন। অনেক সময় এমনও হয়, সাংবাদিক অপরাধ করেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিলেও আমরা হইচই করি। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন ছুটে যায়, আইজি বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে সেই সার্জেন্টের বারোটা বাজিয়ে দেয়। তাই অপরাধ না করেও অনেক পুলিশ সদস্যকে ক্লোজ হতে হয়, বরখাস্ত হতে হয়। সেদিন এক পুলিশ কর্মকর্তা ফেসবুকে তার নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে লিখেছেন, এক সাংবাদিক আইন ভাঙায় তার নামে মামলা দেওয়া হয়।

কিন্তু তিনি নানা জায়গায় ফোন করে, দল ভারি করে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন, যাতে শেষ পর্যন্ত ভুল করেও তিনি বীরের বেশে চলে যান। আর সেই পুলিশ কর্মকর্তা নিরবে সেই জরিমানার টাকা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। পুলিশ কাউকে ধরেই মারপিট শুরু করে না। কারণে-অকারণে একাধিকবার আমার গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আমি কাউকে ফোন না করে জরিমানা দিয়ে দিয়েছি। অকারণে বলছি, কারণ একবার মামলা দেওয়া হয়েছিল গাড়ির নাম্বার প্লেট এক লাইনে হওয়ার কারণে। যদিও সেটা সেভাবেই কিনেছিলাম, আমি বদলাইনি।

পরে সেই সার্জেন্ট বলেছেন, তাদের মামলার টার্গেট দেওয়া থাকে। তাই তাদের মামলা দিতেই হয়। তবে পুলিশ গাড়ি ধরেই মামলা দিয়ে দেয় বা মারপিট শুরু করে না। নিশ্চয়ই অপরপক্ষের উস্কানি থাকে। আমি অনেকবার দেখেছি, ছোটখাটো ভুল করে হাসিমুখে সরি বললে পুলিশও হেসে দেয়।

এই যেমন যে ঘটনা নিয়ে এই লেখা, সে ঘটনায়ও নিশ্চয়ই মুস্তাইন মোটরসাইকেল আটকেই নাসিরউদ্দিনকে মারপিট শুরু করেননি। যতটুকু জেনেছি, হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চালানোর অপরাধে মামলা দিতে গেলে নাসিরউদ্দিন মুস্তকাইনের ওপর চোটপাট শুরু করে, ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে যায় এবং গালাগাল করে। তখনই কেবল মুস্তাইন মেজাজ হারিয়ে ক্যামেরা কেড়ে নিতে গিয়েছিলেন।

নাসিরউদ্দিন সত্যি সত্যি এসব করেছিলেন কিনা জানি না। করলেও মুস্তাইনের অধিকার নেই তার গায়ে হাত তোলার। আমার যেমন পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার অধিকার নেই, তেমনি পুলিশেরও অধিকার নেই আমার ক্যামেরায় হাত দেওয়ার। মুস্তাইন যদি গায়ে হাত না তুলে সাধারণভাবে মামলা দিতো, তাহলে কী হতো? তাহলেও হয়তো আমরা নাসিরউদ্দিনের পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে সাংবাদিক হয়রানির অভিযোগ আনতাম। মুস্তাইনকেও হয়তো সেই পুলিশ অফিসারের মতো নিজের পকেট খেকে জরিমানার টাকাটা দিতে হতো বা ক্লোজ হতে হতো। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি বলছি, মুস্তাইন যদি সাংবাদিকের গায়ে হাত না তুলে তার বিরুদ্ধে মামলা দিতেন, আমি তার পক্ষেই থাকতাম।

পুলিশ অনেক কষ্ট করে এটা যেমন ঠিক। আবার পুলিশ অনেক অপকর্মও করে, এটাও সবাই জানেন। বরং পুলিশের অপকর্মের ফিরিস্তিই বেশি দেওয়া যাবে। অধিকাংশ পুলিশের মোটরসাইকেলে নাম্বার প্লেটের জায়গায় পুলিশ লেখা থাকে। পুলিশের হেলমেট মোটরসাইকেল বা উল্টো পথে চালানোর উদাহরণও ভুরি ভুরি। পুলিশের হওয়ার কথা জনগণের বন্ধু। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাধ্য না হলে জনগণ কখনোই পুলিশের কাছে ভিড়তে চায় না। পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার, আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা প্রায় নিয়মিতই ঘটে। কথায় বলে বাঘে ছুলে ১৮ ঘা, পুলিশে ছুলে ৩৬। পুলিশের বিরুদ্ধে বিনা অপরাধে ধরে নিয়ে হয়রানি করা, ব্ল্যাকমেইল করা, নির্যাতন করা, এমনকি ক্রসফায়ারের নামে খুন করার অভিযোগেরও অন্ত নেই।

পুলিশ খুব খারাপ, তারা আইনের রক্ষক হয়ে আইন ভঙ্গ করে, মানুষকে হয়রানি করে; তাহলে আমাদের এখন কী করতে হবে? পুলিশ বাহিনী তুলে দিতে হবে? পুলিশ ছাড়া আমাদের একদিনও চলবে না। চেষ্টা করতে হবে পুলিশকে আরো মানবিক করে তোলার, তারা যাতে আইনের আওতায় থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সাংবাদিকদের পুলিশকে শুদ্ধ করতে ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করতে হবে। আরেকটা কথা পুলিশ শুধু সাংবাদিকদের সঙ্গে ভালো আচরণ করবে, আর সাধারণ মানুষকে মারবে, হয়রানি করবে; তা যেন না হয়। আইনের চোখে সবাই সমান। পুলিশও যেন সবাইকে আইনের চোখে দেখে।

সাংবাদিকরা খুব খারাপ। তারা আইন মানে না। তারা ‘দাপট’ দেখায়। তারা ‘মাস্তানি’ করে। তারা ‘দালালি’ করে। তাহলে আমাদের এখন কী করতে হবে? সকল মিডিয়া বন্ধ করে দিতে হবে? মিডিয়া ছাড়া আমাদের একদিনও চলবে না। তাহলে কী করতে হবে? সাংবাদিকরা যাতে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেন, আইন মেনে চলেন, বিনয়ী থাকেন, পেশার প্রতি সৎ থাকেন তা নিশ্চিত করতে হবে। কোনও সাংবাদিক আইন ভাঙলে প্রচলিত আইনে তার বিচার হবে, তখনও যেন আমরা তার অন্যায়ের পাশে না দাঁড়াই।

সাংবাদিকদের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্কটা ভালোবাসা এবং ঘৃণার। পুলিশ এমনিতে অন্য অনেকের সঙ্গে যেমন আচরণ করেন, পুলিশের সঙ্গে তেমনটা করতে পারেন না। তাই তারা রাগে গজ গজ করেন। আর সুযোগ পেলেই দু’ঘা বসিয়ে দেন। এই দুই পেশাই বিশেষ ধরনের। যেখানে পুলিশ, সেখানেই সাংবাদিক। পুলিশের মতো সাংবাদিকরাও জেগে থাকেন ২৪ ঘণ্টা। তাই এই দুই পেশার মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-আস্থার সম্পর্ক থাকাটা জরুরি। মনে রাখতে হবে, সবাই যেন আইনের সীমাটা জানি। নিজেদের পেশার প্রতি যেন সৎ থাকি। কেউই যেন আইন হাতে তলে না নেই।

ঢাকা অ্যাটাক দিয়ে শুরু করেছি, ঢাকা অ্যাটাক দিয়েই শেষ করি। সিনেমার মতো বাস্তবেও যেন পুলিশ-সাংবাদিক সম্পর্কটা নিছক ঘৃণার নয়, ভালোবাসারও হয়।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ