সিলেট সুরমা ডেস্ক : র্যাব সদর দফতরে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই শনিবার ভোরে খিলগাঁওয়ে র্যাবের চেকপোস্টে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার চেষ্টা হয়। হামলা চালানোর আগেই দায়িত্বরত র্যাব সদস্যদের গুলিতে ওই আত্মঘাতী জঙ্গির মৃত্যু হয়। নিহত জঙ্গির শরীর ও ব্যাগ থেকে উদ্ধারকৃত শক্তিশালী বোমাগুলো নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। বোমাগুলোর নিষ্ক্রিয়কালে বিস্ফোরণে সেখানকার মাটি, বালি, ইট, পাথর ও ছোট ছোট গাছ অন্তত পনেরো ফুট উপরে উঠে গিয়েছিল। এই নিয়ে টানা চারদিন ধরে দেশে জঙ্গিদের ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জঙ্গিরা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো ধারণা করছে। জঙ্গী তৎপরতা রোধে সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি সাঁড়াশি অভিযান চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের লালখান মাদ্রাসায় অভিযান চালানো হয়েছে। যশোর সদরে অবস্থিত পশু হাসপাতাল সংলগ্ন একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীর আশকোনা ও খিলগাঁওয়ে পৃথক আত্মঘাতী হামলার ঘটনায় নিহত দুই জঙ্গির সুনির্দিষ্ট কোন নাম পরিচয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জানা যায়নি। নিহতদের লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে রয়েছে। পৃথক হামলার ঘটনায় সন্ত্রাস দমন আইনে সংশ্লিষ্ট থানা দুটিতে মামলা হয়েছে। ঘটনাস্থল ও নিহতদের দেহ থেকে সংগৃহীত আলামতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। জঙ্গি হামলার ঘটনার পর বিমানবন্দর, কারাগার, নৌবন্দরসহ সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বাড়তি চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চলছে।
র্যাব জানায়, চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডে দুটি জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অভিযানকালে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। আহত হন কয়েক পুলিশ সদস্য। এরপর থেকেই তারা বাড়তি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। সতকর্তার মধ্যেই শুক্রবার র্যাব সদর দফতরে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে। হামলাকারী জঙ্গীর শক্তিশালী বিস্ফোরণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। এমন ঘটনার পর বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র্যাব প্রতিটি চেকপোস্টে বাড়তি তল্লাশি শুরু করে।
প্রতিদিনের মতো শনিবার রাতেও রাজধানীর খিলগাঁও থানাধীন শেখের জায়গা নামক নির্জন স্থানটিতে চেকপোস্ট বসায় র্যাব-৩ এর একটি দল। দেখা গেছে, খিলগাঁওয়ের নন্দিপাড়া থেকে ডেমরার দিকে রাস্তাটি চলে গেছে। উঁচু রাস্তার দুই পাশে ধানের ক্ষেত ও মাছ চাষ করার বড় বড় ঝিল ও ঘের রয়েছে। রাস্তাটি খুবই নির্জন। আশপাশে তেমন কোন বসতি নেই। সন্ধ্যার পর পরই এলাকাটি নিরব হয়ে পড়ে। শুধু রাস্তাটিতে ঢাকা থেকে ডেমরা এবং ডেমরা থেকে ঢাকাগামী কিছু যানবাহন ও আশপাশের মানুষজন জরুরী প্রয়োজনে যাতায়াত করে। এছাড়া নির্জন এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতি হওয়ার ভয়ে তেমন কেউ যাতায়াত করে না।
র্যাব জানায়, এলাকাটি খুবই নির্জন। স্বাভাবিক কারণেই সেখানে অপরাধমূলক কর্মকান্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য প্রতিদিন রাতেই সেখানে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চলে। মূলত ওই রাস্তায় যাতায়াতকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই চেকপোস্ট বসানো হয়। প্রতিদিনের মতো চেকপোস্টে তল্লাশি চলছিল।
ভোর সাড়ে চারটার দিকে আচমকা একটি মোটরসাইকেল নিয়ে একজন দ্রুতগতিতে র্যাবের চেকপোস্টের কাছে চলে যায়। দায়িত্বরত র্যাব সদস্যরা অন্তত ২০ গজ আগ থেকেই মোটরসাইকেলের আরোহীকে থামার জন্য নির্দেশ দেয়। কিন্তু আত্মঘাতী হামলার চেষ্টাকারী র্যাব সদস্যদের নির্দেশ অমান্য করে মারাত্মক গতিতে মোটরসাইকেল নিয়ে চেকপোস্টের ঠিক কাছে চলে যায়। এ সময় কাঁধে থাকা ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করার চেষ্টা করছিল। সেখানে দায়িত্বরত র্যাব সদস্যরা মোটরসাইকেল আরোহীর গতিবিধিতে মারাত্মক সন্দিহান হয়ে পড়েন। তারা ন্যূনতম সুযোগ না দিয়ে আত্মঘাতী হামলার চেষ্টাকারীকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। এ সময় র্যাবের দুই সদস্য আহত হয়। এক পর্যায়ে আত্মঘাতী হামলাকারী মোটরসাইকেলসহ রাস্তার পাশে পড়ে যায়। দীর্ঘ সময় হামলাকারী সেভাবেই রাস্তার পাশে পড়ে ছিল। কোন নড়াচড়া না করায় তার কাছে যায় র্যাব সদস্যরা। এ সময় সেখানে গুলি শব্দে আশপাশের মানুষ জড়ো হয়। আত্মঘাতী হামলাকারীর চারদিক ঘিরে রাখা হয়। ভোরের আলো ফুটে উঠলে সে যুবকের পাশে একটি পিঠে ঝুলানোর ব্যাগ দেখা যায়। ঘটনার পর পরই র্যাবের বম্ব ডিসপোজ টিমকে খবর দেয়া হয়। দ্রুত বম্ব ডিসপোজাল টিম সেখানে হাজির হয়। সেইসঙ্গে সিআইডির ফরেনসিক টিমও সেখানে যায়।
র্যাব জানায়, দেখা যায় ওই যুবকের নিথর দেহ পড়ে আছে। তার বুকে কিছু একটা বাঁধা দেখতে পাওয়া যায়। আর পাশেই পিঠে ঝুলানো একটি ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখা যায়। র্যাবের বম্ব ডিসপোজাল টিম ব্যাগ ও নিহতের দেহ থেকে শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করে। পরে সেগুলো নিরাপদে নিষ্ক্রিয় করা হয়। নিষ্ক্রিয় করার সময় বোমার বিস্ফোরণে সেখানকার মাটি, বালি, ইট, পাথর ও ছোট ছোট গাছপালা অন্তত পনেরো ফুট উপরে ওঠে গিয়েছিল। বিস্ফোরণে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। বোমাগুলো খুবই শক্তিশালী ছিল বলে র্যাবের বম্ব ডিসপোজাল টিম জানায়। ঘটনাস্থল থেকে নম্বরবিহীন একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার হয়েছে। এছাড়া পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি নিহত জঙ্গির দেহ এবং ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছে। নিহতের শরীরে ৬ থেকে ৭টি গুলি চিহ্ন রয়েছে বলে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের দায়িত্বরত কর্মকর্তা জানান। এসব আলামতের ডিএনএসহ অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। পরে লাশটি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায় পুলিশ।
র্যাবের গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, হামলাকারী নিজের পরিচয় গোপন রাখতেই নম্বরবিহীন মোটরসাইকেল ব্যবহার করেছে। আর শুক্রবারের হামলা সফল না হওয়ায় আবার র্যাবের ওপর হামলার ঘটনাটি ঘটিয়ে থাকতে পারে। দুই হামলার মধ্যে বিশেষ যোগসূত্র থাকাও বিচিত্র নয়। এমনকি দুই হামলাকারী একই আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য হতে পারে।
এদিকে শুক্রবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে আশকোনায় হাজী ক্যাম্প লাগোয়া র্যাবের নির্মাণাধীন সদর দফতরে নিহত আত্মঘাতী হামলাকারীর পরিচয় জানা যায়নি।
শনিবার র্যাবের মুখপাত্র এবং আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, একজন নারী নিজেকে নিহত যুককের মা বলে দাবি করেছেন। ওই নারীর ভাষ্য, তার নাম আমিরন। বাড়ি পিরোজপুরে। ঢাকায় রফিকের চায়ের দোকানে কাজ করত তার ছেলে। পাঁচ দিন আগে বাড়ি থেকে তার ছেলে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। এই নারীর দাবির বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনার দায় স্বীকার করে আইএসের তরফ থেকে আসা বিবৃতির বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলছেন, বাংলাদেশে আইএসের কোন অস্তিত্ব নেই।
এদিকে শনিবার আশকোনায় র্যাব সদর দফতরে নিহত আত্মঘাতী হামলাকারীর ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডাঃ সোহেল মাহমুদ জানান, ইতোপূর্বে আর কোন জঙ্গীর লাশ এত ছিন্নভিন্ন হওয়া দেখা যায়নি। বিস্ফোরণে নিহতের বুক ও পেট ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তার পেটে বেল্ট বাঁধা ছিল। কাঁধের কনুই পর্যন্ত বিস্ফোরণে উড়ে গেছে। নিহতের পেটে ইলেকট্রিক ওয়ার (বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম) পাওয়া গেছে। কাপড়-চোপড় পেটের ভেতর ঢুকে গেছে। ডিএনএ টেস্টের জন্য ওই আত্মঘাতী হামলাকারীর দাঁত, চুল ও ভিসেরা সংগ্রহ করা হয়েছে। তার লিভার ও পাকস্থলীর কিছু অংশ পাওয়া গেছে। একটা কিডনি আছে। হামলার আগে সে শক্তিবর্ধক কিছু খেয়েছিল কিনা জানতে রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।