• ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৭ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ দিল ডাক সুনীল ভোরে…

sylhetsurma.com
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭

সিলেট সুরমা ডেস্ক ::: রক্ত শিমুল তপ্ত পলাশ দিল ডাক সুনীল ভোরে…। বাহান্নর সেই ডাকে রাজপথে নেমে এসেছিল বাঙালী। একুশের অমোঘ বাণী/ দিয়াছে সূর্য আনি…। সেই সূর্যালোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল। আজ সেই ঐতিহাসিক অর্জনের দিন। আজ মাথা নত না কারার অমর একুশে। প্রতিবারের মতো এবারও যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে পালিত হবে জাতীয় শহীদ দিবস। সর্বত্র সকলের কণ্ঠে আজ গীত হবে শোকসঙ্গীতÑ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি…। একই দিন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালিত হবে ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ ডে।
আজ যখন একুশের চেতনাবিরোধী ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠার অপচেষ্টা করছে, পরাজিত পাকিস্তানীরা যখন ইতিহাস বিকৃতির ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত তখন অমর একুশের শক্তিতে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করবে বাঙালী। সমাজের সকল অন্যায়, অসাম্য, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠার নতুন শপথ নেবে। গীতিকবির ভাষায়Ñ স্বাধীন এই বাংলা আমার/ কোটি প্রাণ শহীদ মিনার/ নেবই নেব, নেবই নেব/ নেবই নেব আমরা মনের মতো এই দেশ গড়ে…।
বাংলার প্রতি ঘরে বোনা হয়েছিল একুশের রক্তবীজ। কোথায় বরকত কোথায় সালাম/ সারা বাংলা কাঁদিয়া মরে।/ যে রক্তের বানে ইতিাস হলো লাল/ যে মৃত্যুর গানে জীবন জাগে বিশাল/ সে জাগে ঘরে ঘরে…। বায়ান্নর সে বীজ থেকে আজকের বাংলাদেশ। ভাষার অধিকারের পক্ষে লড়ার পাশাপাশি, ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন শোষণের বিরুদ্ধে একুশ ছিল বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতিসত্তার যে স্ফুরণ ঘটেছিল তা-ই পরবর্তীতে বাঙালির জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মনস্তাত্মিক ও সাংস্কৃতিক প্রেরণা যোগায়।
মহান শহীদ দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদও ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। আজ শহীদদের স্মরণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। একই সঙ্গে সর্বত্র ওড়ানো হবে শোকের কালো পতাকা।
ইতিহাস বলে, ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়। জন্ম নেয় পৃথক দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের দুই অংশ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বাঞ্চলের মানুষ বাঙালী। মাতৃভাষা বাংলা। অপরদিকে পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত ছিল সিন্ধী, পশ্তু, বেলুচ, উর্দুসহ আরও কয়েকটি ভাষা। এ অবস্থায় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নেতৃত্ব সমগ্র পাকিস্তানের আনুমানিক পাঁচ শতাংশের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করে। অথচ তারও অনেক আগে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। মায়ের ভাষার প্রতি বাঙালীর অনুভূতি কত তীব্র ছিল তা জানিয়ে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম লিখেছিলেনÑ যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি…। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এই অনুভূতি স্পর্শ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এ অঞ্চলের মানুষকে পেছনে ফেলে রাখার প্রাথমিক ষড়যন্ত্র হিসেবে ভাষার উপর আঘাত হানে। মায়ের ভাষা বাংলা মুখ থেকে কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বাংলাভাষী মানুষের সকল অনুভূতি তুচ্ছ করে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসতে থাকে শীর্ষ মহল থেকে। এমন ষড়যন্ত্রে হতবাক হয়ে পড়ে বাংলার মানুষ। বাঙালীর সে সময়ের মনোজগত তুলে ধরে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেনÑ মাগো, ওরা বলে/ সবার কথা কেড়ে নেবে।/তোমার কোলে শুয়ে/ গল্প শুনতে দেবে না।/ বলো, মা,/ তাই কি হয়? এর পরও নিজেদের সিদ্ধান্তে স্থির থাকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা। গণচেতনাকে স্তব্ধ করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। এ অবস্থায় বাঙালীর সামনে দুর্বার আন্দোলনের বিকল্প ছিল না। সবাই যেন একসঙ্গে গেয়ে উঠেছিলেনÑ সইমু না আর সইমু না অন্য কথা কইমু না/যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান/এই জানের বদলে রাখুম রে/বাপ-দাদার জবানের মান…। সাধের জান হাসিমুখে বিলিয়ে দিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল বাঙালী। ১৯৪৮ সাল এবং ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম তার প্রমাণ। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানীদের গোয়ার্তুমির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। এদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি রুখতে ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। কিন্তু সকল ভয় জয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজপথে নেমে আসে। বাংলার দাবি চিরতরে স্তব্ধ করতে মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। মাটিতে লুটিয়ে পরে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার ও আবদুস সালাম, শফিক, রফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকে। গীতিকবির ভাষায়Ñ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালী/তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি…। মায়ের ভাষার জন্য বিরল রক্তশ্রোত। রাজপথ ভেসে গিয়েছিল তরুণ তাজা খুনে। ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে আসেন। স্বজন হারানোর স্মৃতি অমর করে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের স্মরণে গড়ে তোলা স্মৃতিস্তম্ভ। ২৬ ফেব্রুয়ারি স্মৃতির মিনার গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ। তবে কাজ হয় না কোন। বাঙালির ভাষার আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ করেছে অমর একুশে।