• ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৯শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

রাবার শিল্প হুমকীর মুখে : হতাশায় গাছ কেটে ফেলছেন বাগান মালিকরা

প্রকাশিত ডিসেম্বর ২৫, ২০১৬

শাকির আহমদ, মৌলভীবাজার
স্বাধীনতা পরবর্তী আশির দশকে ‘সাদা সোনা’ নামে পরিচিত রাবার শিল্প আজ ধ্বংসের প্রায় দ্বারপ্রান্তে। ওই সময় থেকে রাবারের চাহিদা ও যোগানের সমতা, সরকারের পৃষ্টপোষকতা, উদ্যোক্তাদের আগ্রহ রাবার চাষ প্রকল্প বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। দেশের প্রায় ৭০ হাজার একর ভূমির উপর গড়ে উঠেছিলো সরকারী বেসরকারী অসংখ্য রাবার বাগান। ১৯৮০ সালের দিকে বিদেশ থেকে রাবার আমদানীর বিকল্প হিসেবে উৎপাদনে উৎসাহ দেয়ার অর্ধশতাব্দীর মাথায় আবার এই দেশের সরকার ও উদ্যোক্তা আমদানীনির্ভর হওয়ায় রাবার বাগান মালিকরা চরম হতাশায় ভোগছেন। আর গত ৫ বছর লাগাতার দরপতনে এই হতাশা রুপ নিয়েছে প্রকট আকারে। কেউ বাগানের গাছ কেটে ফেলেছেন, কেউবা বাগান বন্ধ রাখেছেন। রাবার কাঁচামাল কৃষি পণ্য হওয়া সত্ত্বেও শিল্প পণ্য হিসেবে দেশের বাজারে ভ্যাট দিতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ। অথচ, রাবার কাঁচামাল বাজার উপযোগী করতে প্রতি কেজিতে খরচ হয় বর্তমান বিক্রি মূল্য থেকে প্রায় ৯০ টাকা বেশী।
রাবার সংগ্রহের উৎকৃষ্ট সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম হওয়ার কারণে এই সময়ে দেশের বাগান মালিকরা রাবার সংগ্রহ করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। আমদানীকৃত রাবারের তুলনায় দেশীয় রাবারের উপর করভার বেশী হওয়ায় অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে দেশীয় উৎপাদিত রাবার। আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতন এবং দেশীয় রাবারের উপর করভার বেশী হওয়ায় উদ্যোক্তারা বিদেশী রাবার ক্রয় করছেন। সরকারের অবহেলা এবং উদ্যোক্তাদের দেশীয় বাজারের প্রতি উদাসীনতায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে মোট সরকারী রাবার বাগান ১৮টি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জোনে ৯টি, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ জোনে ৫টি, সিলেট জোনে ৪টি বাগান রয়েছে। এছাড়াও সারা দেশে বেসরকারী ও ব্যক্তিমালিকানাধীন অসংখ্য রাবার বাগান রয়েছে। দেশে রাবারের চাহিদা ৩০ হাজার টন। তন্মধ্যে বেশিরভাগ (১৬-২০ হাজার টন) দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমান দেশে যে পরিমান রাবার উৎপাদন হয় তা দিয়ে দেশের চাহিদার প্রায় ৭০ ভাগ মেটানো সম্ভব হলেও বিদেশ থেকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশী রাবার আমদানী করা হচ্ছে। রাবার আমদানী নামমাত্র শুল্ক হওয়ার কারণে দেশের বাজার দরের চেয়ে কম দামে ভিয়েতনাম থেকে রাবার আমদানী করা হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে দেশের সব বেসরকারী রাবার বাগানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
জানা যায়, মুক্তবাজারের ফলে বিদেশী রাবারে বাজার সয়লাব। রাবার আমদানীতে নামমাত্র শুল্ক বসানো এবং দেশীয় রাবার বিক্রিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট এবং রাবারের উৎপাদন খরচ বেশী, বিক্রির দাম কম এমন নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত দেশের রাবার শিল্প। এমতাবস্থায় দেশের সরকারী ১৮টি রাবার বাগান বড় অঙ্কের লোকসান দিয়ে টিকে থাকতে পারলেও ব্যক্তি বাগান মালিকরা হতাশায় নিরুপায় হয়ে বাগান বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন রাবার বাগান মালিকরা। কেউ কেউ বাগানের গাছ কেটে বিকল্প চিন্তা করছেন। ফলে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাধীন রাবার বাগান। আর এতে লোকসানের মুখে পড়ছে দেশের অর্থনীতির চাকা।
বাংলাদেশ রপ্তানী উন্নোয়ন ব্যুরো-এর তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের (জুলাই-নভেম্বর) এর লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১১.২০ শতাংশ, অর্জিত হয়েছে ৭.২৬ শতাংশ। এসময়ের অর্জিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৩৫.১৭ শতাংশ কম। যা বিগত বছরের রপ্তানীর তুলনায় ১৯.২৪ শতাংশ কম। এ বিষয়ে বাংলাদেশ রাবার উন্নয়ন কর্পোরেশনের মহা-ব্যবস্থাপক মো: মোয়াজ্জেম হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের স্টক অনেক, রাবারও ভালো কিন্তু বিক্রি নেই। মুক্তবাজার হওয়ার ফলে বাংলাদেশে রাবারের মূল্য নিচে নেমেছে। পাশাপাশি ভ্যাট বসানোয় এর প্রভাব পড়েছে রাবার বিক্রির উপর।
বেসরকারী রাবার মালিকরা জানান, ২০১০-১২ সালে রাবারের দাম ছিলো কেজি প্রতি ২৮০-৩২০ টাকা, ২০১৩-২০১৪ সালে দরপতনে ১২০-১৩০ টাকা হয়। বর্তমানে প্রতি কেজি রাবারের দাম ৭০-৯০ টাকা। অথচ দেশের বাগানগুলোয় রাবার উৎপাদনের পর তা প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে বিক্রির উপযোগী করতে খরচ হয় প্রায় ১৬০ টাকা। এতে মুনাফা তো দূরের কথা বাগান শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন দেয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এই লোকসান চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
রাবার বাগানের গাছ কেটে ফেলা বেসরকারী মুড়ইছড়া চা বাগান ও ব্যক্তিমালিকানাধিন বাগানের মালিক মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার আব্দুল মতলিব, আব্দুল লতিফ, মো. আবু হানিফ, বড়লেখার দক্ষিণভাগের ঈমান উদ্দিন জানান, দীর্ঘ ৫ বছর ভর্তুকি দিয়ে বাগান চালু রেখেছিলাম, মনে হয়েছিলো দাম হয়তো পূনরায় বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে দরপতনে আমরা মারাত্মকভাবে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলাম। এক পর্যায়ে বিভিন্ন ঋণ শোধ করতে গিয়ে আমাদের গাছ কাটতে হয়েছে।
এছাড়াও বাগান বন্ধ রেখেছেন এমন বাগান মালিক বজলুল করিম চৌধুরী আমিন, আলহাজ্জ্ব মো. আব্দুস সহিদ, রোশন আহমদ, কামাল আহমদ ও জাহাঙ্গির কবির আলাল জানান, রাবারের কাঁচামালের বিক্রয়মূল্য থেকে উৎপাদন খরচ বেশী হওয়ায় বাগান চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে মুনাফা তো দূরের কথা কর্মচারীর বেতন দেয়া সম্ভব হয় না। তাই বাগান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আগে যেখানে প্রতি কেজি রাবার বিক্রি হতো ৩০০ টাকা আজ ২ বছর যাবৎ বিক্রি করতে হচ্ছে ৭০ টাকা।
এবিষয়ে সিলেট জোনের অধিনস্থ ভাটেরা সরকারী রাবার বাগানের ব্যবস্থাপক মকবুল হোসেনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, সিলেট জোনের ৪টি সরকারী বাগানই পুরাতন। এসব রাবার বাগানে উৎপাদন ভালো কিন্তু বিক্রয়মূল্য কম হওয়াতে লোকসানের সম্মুখিন হতে হচ্ছে।
উল্লেখ্য, রাবার দিয়ে যানবাহনের টিউব-টায়ার, জুতা, স্যান্ডেল, হোসপাইপ, বাকেট, গ্যাসকেট, ওয়েলসিল, অটোমোবাইল পার্টস, টেক্সটাইল জুট, স্পেয়ার্স ইত্যাদি পণ্য তৈরী হচ্ছে।