ধ্যানের নীল আকাশইতো চাই, সেই সঙ্গে চাই পারাপারহীন হাওড়ের বৈরাগ্য আর উদাসীন নিষ্ঠুর সৌন্দর্য্য। চাই সুধা-শ্যামলীন ভালোবাসার জীবনের জন্য আর্তি। আদিগন্ত ব্যপ্ত বিষাদের অভিমান, কান্না-হাসির খড়ির গন্ডি পেরিয়ে যাওয়া বাচনাতীত অনুভব। অজস্র ধরনের কীর্তিমতা ও মরীচিকায় ঠাসা নাগরিক কীর্তিমতা কী দিতে পারে এত সব? না, পারে না। তাইতো মেকি জীবনে অভ্যস্ত আমরা আটপৌঢ়ে নাগরিকরা ফিরে ফিরে চলি প্রকৃতির অপার সন্ধানে। সিলেট পুলিশের বড় কর্তা (ডিআইজি) মো. মিজানুর রহমান পিপিএম-ও হয়তো এমন সন্ধানই করেছিলেন। প্রকৃতিদর্শনে তাঁর মনও হয়তো বৈরাগ্য হয়ে উঠেছিল। তাইতো হঠাৎ একদিন নাগরিক যান্ত্রিকতা দূরে ঠেলে সিলেটে কর্মরত সাংবাদিকদের নিয়ে ঝাঁপ দিলেন টাঙ্গুয়ার হাওড়ে।পুলিশ-সাংবাদিকের টাঙ্গুয়া বিলাসের পুরো চিত্রই তুলে এনেছেন সিলেট সুরমার প্রতিবেদক আব্দুল আহাদ।
নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যরে আধার সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়। টেকেরঘাট ও বারেকটিলায় পর্যটন শিল্প গড়ে উঠার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে না। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, পর্যটকরা অনেক কষ্ট করে হলেও ছুটে আসেন এখানে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে। সিলেট রেঞ্জ পুলিশের উদ্দেগে টাঙ্গুয়ার হাওড় পরির্দশন করেন সাংবাদিকবৃন্দ। গতকাল (শুক্রবার) সিলেটের ডিআইজি মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে সিলেটে কর্মরত সাংবাদিকবৃন্দদের নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওড় পরির্দশনে যান।
এ সময় তিনি বলেন, এই বর্ষটা টুরিস্ট বর্ষ তাই পর্যটকদের নিরাপতার বিষয়টা মাথায় রেখে আমাদের র্কাযক্রম পরিচালনার অংশ হিসাবে আমরা এখানে এসেছি। এখানে অনেক সমস্যা আছে। নেই টুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পর্যটকদের টয়েলেট ব্যবস্থা। এসব সমস্যা সমাধানে মন্ত্রনালয় এগিয়ে আসবেন। মুলত এখানে নিরাপতার দ্বায়ীত্ব সিলেট রেঞ্জ পুলিশের উপর। পর্যটকদের নিরাপক্তা দেয়ার পাশাপাশী বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরে একটি রেষ্ট হাউজ নির্মাণ করা হবে। পর্যটকরা যেনও কোনো হয়রানি বা সন্ত্রাসিদের কবলে না পড়েন সেই ব্যবস্থা করবো। সুনামগঞ্জ হাওড় প্রধান জেলা। বড় বড় হাওড় শীতে শুকিয়ে গেলে সবুজ ফসলে ভরে যায়। আর বর্ষায় হাওড়গুলো পানিতে ভরে গিয়ে মাছের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়। বর্ষায় বিশাল হাওড়ে সাগরের মতো টেউ। শীতকালে কুয়াশা ঢাকা প্রান্তরে অতিথি পাখির কলকাকলী। এক নয়নাভিরাম দৃশ্যপটের টাঙ্গুয়াকে ঘিরে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সরকারেরও প্রতিশ্রুতি ছিল এখানে পর্যটনশিল্প গড়ে তোলার। সুন্দরবনের পরেই এটি দ্বিতীয় রামসার সাইট।
হাওড়টি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বকোণে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলা জুড়ে। উত্তরে রয়েছে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। হাওড়টির আয়তন প্রায় ৪ হাজার একরের মতো। বর্ষাকালে এর আয়তন দাঁড়ায় ২০ হাজার একরের বেশি। শীত যত বাড়ে অতিথি পাখির আগমনও বাড়ে। “টাঙ্গুয়ায় এখন আগের মতো আর পাখি আসে না, বিশাল হাওড়টি মাছ শূন্য হয়ে যাচ্ছে শিকারীদের অত্যাচারে। এগারো কিলোমিটার দৈর্ঘ ও সাত কিলোমিটার প্রস্থের মধ্যে ৫১টি বিল সমন্বয়ে হাওড়টি দেশের ‘মাদার ফিশারিজ’ হিসাবে খ্যাত। ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইটের মর্যাদা লাভ করে এই টাঙ্গুয়ার হাওড়। এটি বিশ্ব ঐতিহ্যেরও অংশ। ভারতের মেঘালয় পাহাড়রে কোল ঘেঁষে জেলার তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলায় এর অবস্থান। স্থানীয়দের কাছে ‘নয় কুড়ি বিল আর তের কুড়ি কান্দা’ হিসাবে পরিচয় এ হাওড়ের। হাওড় পাড়ের ৮৮টি গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকা এ হাওড়কে ঘিরে। টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৪১ প্রজাতির মাছ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণি, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৭ প্রজাতির গিরগিটি, ২১ প্রজাতির সাপ এবং ২০৮ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এই হাওড়ে আছে দুর্লভ প্রজাতির প্যালাসিস ঈগল পাখি।
অপার সম্ভাবনাময় টাঙ্গুয়ার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য হাতছানি দেয় প্রতিনিয়ত। ‘টাঙ্গুয়াকে ঘিরে পর্যটনশিল্পের বিকাশে এগিয়ে এলে প্রতি বছর বিপুর পরিমাণ রাজস্ব আয় হতো, মন্তব্য করেন তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামীলিগের সভাপতি মো. আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটছে না। জাদুকাটা নদীর তীরে ৭শ ফুট উঁচু বারেক টিলা, টেকেরঘাট ও টাঙ্গুয়ায় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত। ২০০৫ সালে জেলা প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংগঠন দ্য ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন যৌথভাবে হাওড়ের জীববৈচিত্র রক্ষার দায়িত্ব নেয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে আজও এর সুফল আসছে না। ক্রমাগত কমছে পরিযায়ী পাখি ও মাছ। হাওড় পারের মানুষেরা বলেন, টঙ্গুয়া ঐতিহ্য হারাচ্ছে এর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। পরিবেশ ও প্রতিবেশগত দিক থেকে ঝুঁকিপুর্ণ এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করে ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সরকারি ব্যবস্থাপনার অধীনে আনা হয় টাঙ্গুয়ার হাওড়কে। সরকারের এই দেখাশোনার উদ্দেশ এখানকার জীবিবৈচিত্র সংরক্ষণ, হাওড়পাড়ের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। ২০০১ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ড সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। পরে ভূমি মন্ত্রণালয় হাওড়ের মালিকানা হস্তান্তর করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের নিকট। দীর্ঘদিনের প্রচলিত ইজারা প্রথা বাতিল হয়ে এই হাওড়ের দেখভালের দায়িত্ব পড়ে জেলা প্রশাসনের উপর।
২০০৫ সালে শুরু হয় সরকার, এনজিও এবং জনগণের অংশগ্রহণ ভিত্তিক বিশেষ কার্যক্রম। যাত্রালগ্নে এর বেশকিছু সফলতা আসলেও সেটি আর ধরে রাখা যায়নি। বর্তমানে টাঙ্গুয়ায় মাছের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ হাওড়কে নিরাপদ মনে করে শীতে দ্বিতীয় রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওড়ে হিজল কড়চবাগ, কান্দা ও জলাবনে এসে আশ্রয় নেয় পাখি। কিন্তু পাখির আবাসস্থল ধ্বংশ, খাদ্য সংকট ও শিকারীদের অত্যাচারে পাখির সংখ্যাও কমে গেছে। বর্ষায় মাদার ফিশারিজ টাঙ্গুয়ার আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় ২০হাজার একরে। টাঙ্গুয়ার হাওড়টি সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ ছিলো জেলার অন্যান হাওড়ের মাছের পরিমান বৃদ্ধি করা। তাই এটির ইজারা প্রথা বিলুপ্ত করে অভয়াশ্রম করা হয়। সারা বছর এখানে মাছধরা নিষিদ্ধ। সার্বক্ষণিক একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ ও আনসারবাহিনী পাহারা দেয়। নিষিদ্ধ থাকায় টাঙ্গুয়ার হাওড়ে মা মাছ নিরাপদে ডিম ছাড়ার কথা এবং পোনামাছ বিভিন্ন হাওড়ে প্রবেশ করে মাছের উৎপাদন বাড়ার কথা। কিন্তু টাঙ্গুয়া এখন নিজেই মাছশূন্য বলেন এলাকাবাসী। বিষেশজ্ঞরা মনে করেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় এটি সঠিকভাবে রক্ষা হচ্ছে না। তারা বলেন, এই সম্পদ রক্ষায় সরকাকেই উদ্যোগী হতে হবে। কাগজে-কলমে টাঙ্গুয়া সংরক্ষিত। কিন্তু রাতের আঁধারে নৌকাপ্রতি নজরান দিয়ে মাছ যে লুটে নেয়া হয় তা ওপেন সিক্রেট।