এম এ মালেক
আর মাত্র একদিন পর আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল। কাউন্সিলকে ঘিরে সিলেটে যেমন চলছে উৎসব, চলছে নানা আলোচনা। নেত্রীর গুড বুকে কে ঢুকছেন আর কে ছিটকে পড়ছেন এমন বিশ্লেষণ এখন সর্বত্র। কেন্দ্র থেকে সিলেটÑ সর্বত্র তিন নেতাকে নিয়েই আলোচনা বেশি। অনেকের ধারণা দু’বারের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের স্থলে এবার আসতে পারেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান অথবা আজিজুস সামাদ ডন।
কামরান সিলেটের জননন্দিত নেতা। সিলেট সিটি করপোরেশনের দু’বারের নির্বাচিত মেয়র। এর পূর্বেও ছিলেন পৌরসভার চেয়ারম্যান। ছিলেন পৌর কমিশনারও। জনপ্রতিনিধিত্বের ২৬ বছরের ক্যারিয়ার তাঁর। গত সিটি নির্বাচনে বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হয়ে গেলেও এখনো নগরীর প্রধান অভিভাবক হিসেবে কামরানকেই মানেন অনেকে। মেয়র পদে হেরে গেলেও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে উঠেননি তিনি। বরং মেয়রহীন গত কয়েক বছরে আরো বেশি জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছেছেন জনপ্রিয়তার ম্যাজিক ম্যান হিসেবে খ্যাত কামরান। যে কারণে চেয়ারহীন কামরানকে যোগ্য কোনো চেয়ারে বসানোর জিকির উঠেছে তৃণমূলে।
এদিকে, কেন্দ্রীয় সূত্রের দাবি সারা দেশে ৮২ সদস্যের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। নেত্রীর গুড বুকে রাখা এ তালিকা থেকেই বাছাইকৃতরা স্থান পাবেন কেন্দ্রীয় কমিটিতে। যে তালিকায় কামরানের সাথে আজিজুস সামাদ ডনের নাম রয়েছে বলে সূত্রের দাবি। তবে মিসবাহ উদ্দীন সিরাজ কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়ছেন কি-না এমন কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকলেও কামরানকে মূল্যায়ন করা হচ্ছেÑ তা অনেকটা নিশ্চিত।
তবে শেষপর্যন্ত সিলেট থেকে কেন্দ্রে কে যাচ্ছেনÑ এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে ভোট গণণা শেষে। কেন্দ্রে স্থান পাওয়া নিয়ে সিলেটের বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ আর আজিজুস সামাদ ডনের নাম উঠে এসেছে। এ তিন নেতা জোর লবিং চালাচ্ছেন। এছাড়া আগামী ২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীরাও এখন সক্রিয় হয়ে ওঠেছেন। কাউন্সিলর ও ডেলিগেট কার্ড পাওয়া নিয়েও চলছে তদবির ও লবিং। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগে থেকে ৩৫ কাউন্সিলর ও ৩০০ ডেলিগেটের তালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। অপরদিকে জেলা আওয়ামী লীগ থেকে ১৬৪ কাউন্সিলর ও প্রায় ১৫০০ ডেলিগেটের তালিকা কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। সম্মেলনের ব্যাপারে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, সারাদেশেই এখন আলোচনার বিষয় আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ এ সম্মেলনে স্বত:স্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করবে। ইতোমধ্যেই কাউন্সিলর-ডেলিগেটের তালিকা ও সাংগঠনিক প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। সম্মেলনের পূর্বে প্রচার মিছিলেরও আয়োজন করা হয়েছে।
কাউন্সিলর-ডেলিগেট কার্ড নিয়ে তদবিরের ব্যাপারে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি ২৫ হাজার নাগরিকের জন্য একজন কাউন্সিলর হবে। তাই সিলেট মহানগর ইউনিট থেকে ৩৫ জনকে কাউন্সিলর করা হয়েছে। অনেক নেতারা কাউন্সিলর কার্ড পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করলেও গঠনতন্ত্রের বাইরে কিছু করা যাবে না। তবে তাদের ডেলিগেটের তালিকায় রাখা হয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদক শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, কেন্দ্রীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে তৈরি করা হয়েছে জেলা ও উপজেলা শাখার সাংগঠনিক প্রতিবেদন। ইতোমধ্যে এই প্রতিবেদনগুলো কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটি উপজেলা থেকেই কাউন্সিলর ও ডেলিগেট দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৬৪ জন কাউন্সিলর ও প্রায় দেড় হাজার ডেলিগেটের নাম পাঠানো হয়েছে। গঠনতন্ত্র মেনেই এগুলো করা হয়েছে। তদবির থাকলেও সেগুলো বিবেচনায় আসেনি।
মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ প্রথম সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০৮ সালে। এক-এগারো পরবর্তী সময়ে সংস্কারপন্থির তকমা জুটায় আওয়ামী লীগের ডাকসাইটের নেতা ছাত্রলীগের এক কালের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদের দল থেকে ছিটকে পড়ায়ই মূলত কপাল খুলে মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের। ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ১৮তম সম্মেলনে সিলেট বিভাগের কোটায় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তখনকার সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে টপকে মহানগরের সাধারণ সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পাওয়াটা তখন চমক হয়েই এসেছিলো। ২০১২ সালে ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের ১৯তম সম্মেলন। এ দফায়ও তার উপরই ভরসা রাখে দল। সিলেট বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্ব আবারও মিসবাহ সিরাজেরই কাঁধে তুলে দেওয়া হয়। অনেকেই মনে করছেন এবার বোধহয় আরো একটু উপরে উঠবেন মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। তবে কি যুগ্ম সম্পাদকের চেয়ারটি হাতছানি দিচ্ছে মিসবাহ উদ্দিন সিরাজকে?
দুই দফায় ৭ বছর আওয়ামী লীগের দায়িত্ব সামলানোর পর মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের চোখ বোধহয় এখন কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদকের পদটিতে। অনেকেই মনে করছেন দীর্ঘদিন একই পদে থাকার পর তিনি বোধহয় একটু উপরে উঠতে চাইছেন। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ায় মূল নেতৃত্বের কাছাকাছি অনেক দিন ধরেই। অনেকের সাথেই ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তাদের সমর্থনও রয়েছে তার সাথে। এজন্যই একটু উপরের দিকে চোখ তুলে তাকানোর ক্ষমতা তার হাতে ধরা দিয়েছে বলে আওয়ামী রাজনীতি সংশ্লিষ্ট অনেকেরই ধারণা।
অন্যদিকে মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ এখনই যে যুগ্ম সম্পাদকের জন্য বিবেচিত হতে পারেন-এটা মানতে চাচ্ছেন না অনেকে। তারা মনে করেন আরো এক টার্ম হয়তো সাংগঠনিক সম্পাদকের পদেই রেখে দেওয়া হবে মিসবাহ উদ্দিন সিরাজকে। নাম না প্রকাশের শর্তে তাদের অনেকেরই বক্তব্য, উপরে উঠার মতো এমন হাই পারফর্মেন্স এখনও দেখাতে পারেননি মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। কেন্দ্রে যোগ বাড়লেও তৃণমূলে কিন্তু অনেকের সাথেই দূরত্ব বেড়েছে মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে কোন্দলের আগুনে ঘি ঢালার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। তাছাড়া দখলবাজি-টেন্ডারবাজির ক্ষেত্রে তার প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগগুলো তার নামের পাশে ‘ডিমেরিট পয়েন্ট’ যোগ করছে। এসব অভিযোগের কিছু কিছু নেত্রীর কান পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট কিছু সূত্র থেকে আভাস মিলেছে। আর এমনটি হলে মিসবাহ সিরাজের কপাল পোড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। অর্থাৎ কমিটি থেকেই ছিটকে পড়তে পারেন তিনি।
নিজের কর্মকা-ে অনেকটাই সন্তুষ্ট তিনি। মূল্যায়নের ব্যাপারেও যথেষ্ট আশাবাদী। কি পদ আশা করেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তার কর্মকান্ড বিবেচনা করে দল তাকে যে দায়িত্বই দেবে তিনি তা পালনের জন্য প্রস্তুত আছেন। দলের নেত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া যেকোনো দায়িত্বই তিনি মাথা পেতে নেবেন বলে জানান মিসবাহ সিরাজ।