সিলেটে বর্বরতা বাড়ছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির পরিসংখ্যানে সাম্প্রতিক সময়ের বর্বরতার চিত্র আঁতকে উঠার মতো। পান থেকে চুন খসলেই ঘটছে অঘটন। হামলা, নির্যাতন, ছিনতাই, রাহাজানি এখন সিলেটে অনেকটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে দাঁড়িয়েছে। বাড়ছে হত্যাকান্ডও। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় বর্বরতার সিংহভাগই ঘটছে প্রকাশ্যে। আইনি তৎপরতা কিংবা শাস্তি না থাকায় দিন দিন অপরাধীরাও হয়ে উঠছে বেপরোয়া। এতে একেকটি ঘটনা ধারাবাহিকভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটছে ভয়াবহ আকার নিয়েÑ যা লোকাল এরিয়া ছেড়ে দেশ তথা আন্তর্জাতিকভাবে তোলপাড় সৃষ্টি করছে। রাজন, সাঈদ, মামুন, শাকিল, তাজুল, নূরজাহান হত্যা, বাহুবলে চার শিশুকে মাটিচাপা আর খাদিজার চিত্র তার জ্বলন্ত উদাহরণ। প্রতিনিয়িত বর্বরোচিত হামলার শিকার হচ্ছে নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। অপরাধীদের নির্মম নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ পর্যন্ত সিলেটে ঘটে যাওয়া প্রতিটি নির্যাতনের পিছনে রয়েছে সরকারদলীয় নেতাতর্মীদের সংশ্লিষ্টতা। সিলেটে পূর্ব বিরোধের জের ও প্রেমঘটিত কারণেও একে অপরকে পিটুনি দিয়ে হত্যা করছে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে সিলেটে বাকবিতন্ডার জের ধরে প্রাণ দিতে হয়েছে জিন্দাবাজারের ব্যবসায়ী মামুন, লালাবাজারের শাকিল আহমদকে। প্রেমঘটিত সমস্যার কারণে প্রাণ দিতে হয় কানাইঘাটের ইমরানকে, নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা ও নূরজাহান কলেজের ছাত্রী ফাতেমাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রীকে অপহরণ করে তুলে নেয়ার চেষ্টার ঘটনাও ঘটেছে। আর পারিবারিক বিরোধের জেরে প্রাণ দিতে হয় বিএনপি নেতা তাজুল ইসলামকে। এদিকে, গত ৩ অক্টোবর শাবি ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুলের হামলার শিকার হন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ডিগ্রী ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজা আক্তার নার্গিস। এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে নার্গিসকে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক আহত করেছে বদরুল। এ লোমহর্ষক ঘটনায় দেশ জুড়ে চলছে তোলপাড়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে আহত কলেজ ছাত্রী নার্গিস।আর অন্যদিকে ঘাতক বদরুল আলমের দৃষ্টান্তমূরক শাস্তির দাবী করছে সমাজের সর্বস্তরের লোক। গত ৪ অক্টোবর সোবহানীঘাটের হোটেল মেহেরপুর থেকে শাকিল নামের এক ব্যবসায়ীর গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। শাকিল আহমদ দক্ষিণ সুরমার মোগলাবাজারের শ্রীরামপুরের লাল মিয়ার ছেলে বলে জানা গেছে।তবে এ ঘটনায় পুলিশ দাবী করছে শাকিল সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ দিকে গত ৪ সেপ্টেম্বর সিলেটের কানাইঘাটের টেইলারিং ব্যবসায়ী ইমরান হোসেননের বন্তাবন্দী অবস্থায় পুকুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এ সময় ইমরানের হাত ও পা ভাঁঙ্গা গলা কেঁটে, লিঙ্গ কর্তন করে, হাত ও পা ভেঙ্গে হত্যার পর রাতের আধারে তার লাশ চটের বস্তায় ভরে বস্তার নীচ অংশে গাছের সাথে বেঁধা অবস্থায় পুকুরে ডুবিয়ে রাখা ছিল। এ ঘটনায় ইমরানের প্রেমিকা সুহেদা কেগমকে আটক করে পুলিশ। পরবর্তীতে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে প্রেমিক ইমরান হোসেনকে খুনের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে ইমরানের কথিত প্রেমিকা সুহাদা বেগমসহ আটককৃত আরো তিনজন। সিলেটে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে সর্বশেষ খুনের ঘটনা ঘটে গত ১৬ আগস্ট। সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারের এ্যালিগেন্ট শপিং সিটির পার্কিংয়ের সামনে মোটর সাইকেল রাখা নিয়ে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে জেলা ছাত্রলীগের স্থগিত কমিটির সহ সভাপতি এম. সুলেমান হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে ওই মার্কেটের ব্যবসায়ী করিম বক্স মামুনকে ছুরিকাঘাত করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঐদিন দিবাগত রাতেই মামুন ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। এ ঘটনায় পরদিন সুলেমান হোসেন চৌধুরীকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ আজীবনের জন্য বহিস্কার করে। ১৯ আগস্ট শুক্রবার দক্ষিণ সুরমার লালাবাজারে বাগবিত-ার জেরে ছাত্রলীগ নেতা আজাদের নেতৃত্বে খুন করা হয় মো. আজির মিয়া (৪৫) নামের এক ফার্মেসি মালিককে।সূত্রে জানা যায় আজির মিয়ার ফার্মেসিতে চিকিৎসা পরামর্শ দেন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডা. নাদির হোসেন চৌধুরী। ১৭ আগস্ট বুধবার রাতে তার গাড়িটি স্থানীয় জুনাব আলী রাইস মিলের সামনে পার্কিং করে তিনি চেম্বারে আসেন।এ সময় সাহানীয় ভরাউটা গ্রামের আজাদ তার গাড়ি দিয়ে ডা. নাদিরের গাড়ির পেছনে ধাক্কা দেন। এতে ডা. নাদিরের গাড়িটি ক্ষতিগস্ত হয়। এ নিয়ে ফার্মেসি মালিক আজির মিয়ার সঙ্গে আজাদের বাগবিত-া হয়।আর এর জেরেই পিটিয়ে হত্যা করা হয় আজির মিয়াকে। গত ২০আগস্ট শনিবার দুপুর ১২টায় সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার চন্ডিপুরে এলাকায় প্রেমের প্রস্থাবে সাড়া না দেওয়ার কারণে নুরজাহান কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তারকে ছুরিকাঘাত করে লিটন নামের এক বখাটে।এ সময় স্থানীয়দের সহযোগীতায় গুরুতর আহত অবস্থায় ফাতেমাকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।এ সময় বখাটে লিটনকে আটক করা হয়। এ দিকে একই দিন ২০ আগস্ট রাত ১০টার দিকে নগরীর কুয়ারপাড় গরম দেওয়ান মাজার এলাকায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর শাহানা বেগম শানুর স্বামী এবং স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা তাজুল ইসলামকে কুপিয়ে খুন করে সন্ত্রাসীরা।তবে এ ঘটনার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে পূর্ব বিরোধের জের ধরে তাজুলের উপর হামলা হয়েছে বলে দাবী করা হয়েছে। এর আগে পারিবারিক বিরোধকে কেন্দ্র করে তাজুল ইসলামের ছেলে রায়হান ইসলামকে খুন করে প্রতিপক্ষের লোকজন। এর বদলা নিতে তাজুল ইসলাম খুন করে তার প্রতিপক্ষ। চলতি বছরের ১০ জুলাই নগরীর পাঠানটুলায় একটি বাসার দখল নিয়ে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হামলায় খুন হন স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা আব্দুল্লাহ অন্তর। এ ঘটনায় অন্তরের স্ত্রী বাদি হয়ে থানায় মামলা দায়ের করলেও এখনো হত্যাকান্ডের মূলহোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। গত ১ মে নগরীর শামীমাবাদে ইসলাম হোসেন নামের এক শ্রমিককে কুপিয়ে খুন করে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। এ ঘটনায় নিহতের ভাই বাদি হয়ে থানায় মামলা করলেও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা ধরা পড়েনি। ৮ জানুয়ারি সিলেট সদর উপজেলার খাদিম বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে খাদ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বনফুলের দুই ফ্যাক্টরি তাফু ও রাজু শ্রমিক নিহত হন। এছাড়া, রাসেল(২২) নামে আরেক শ্রমিক আহত হয়েছিলেন। চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি সিলেট সফরে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগের দিন নিজ দলের ক্যাডারদের হামলায় নিহত হন সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিবিএ ৪র্থ বর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী কাজী হাবিবুর রহমান হাবিব। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৪ ছাত্রকে বহিস্কার করে। এদের সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ও ওই হত্যা মামলার আসামি।