• ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২২শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

স্মৃত্বির পাতায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদির

sylhetsurma.com
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৬

এম.এ. মালেক :::::
বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ একটি চির গৌরবোজ্জল ঘটনা। এই যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়েই এই জাতি বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যূদয় ঘটিয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। আর চির উন্নত শির ও চিরসংগ্রামী জাতি হিসেবে এই মুক্তিযুদ্ধই বাঙালি জাতিকে করেছিল মহান। যারা এই মহান মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছিলেন, সরাসরি অস্ত্র হাতে লড়েছিলেন পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে, তারা এ জাতির মহান সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। তাদের তেজোদ্দীপ্ত শপথ, শত্রু বিনাশের তীব্র আকাংখার কারণেই বারুদে পোড়া প্রায় এই প্রিয় ভূখন্ড আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে পত পত করে উড়েছিল লাল বৃত্তখচিত সবুজ পতাকা। তাদের মধ্যে অন্যতম এক বীর সেনানী সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ২৬ নং ওয়ার্ডের  কদমতলী এলাকার বাসিন্দা বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, প্রগতিশীল মুক্তবুদ্ধির চর্চায় এক উচ্চকিত কন্ঠ বীর মুক্তিযোদ্ধা ম. আ. মুক্তাদির। যারা মুক্তযোদ্ধা মুক্তাদিরকে স্বশরীরে জানেন না, কিংবা যারা জানেন তাদের সকলেই তার কর্ম ও কর্মোদ্দীপনা ছিল অনুপ্রেরণার বিষয়।

17

যিনি ভালবাসতেন মানুষকে তার অন্তর দিয়ে, মানব মুক্তির জয়গান যার জীবনের আদর্শ ছিল, যিনি আমৃত্যু স্বপ্ন দেখে এসেছেন একটি অসাম্প্রদায়িক, অসাম্য, শ্রেণিবিভেদহীন বর্জোয়াদের থাবা বিহীন সা¤্রাজ্যবাদের বায়ালগ্রসহীন, একটি বাংলাদেশের তিনিই তো বাঙালির পরম বন্ধু, যার ভাবনা জুড়ে বিস্তৃত ছিল খেটে খাওয়া জীবন যন্ত্রনা ও সেই যন্ত্রনা থেকে মুক্তির তীব্র আকুতি যিনি মুক্তবুদ্ধি দিয়ে রাজনীতি করতেন উচ্চকন্ঠে উচ্চশিরে, যিনি চাইতেন সমাজের অমূল্য পরিবর্তন ও অগ্রসর চিন্তার মানুষের বিপ্লব, তিনিই বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদির। এই বীর যোদ্ধার জীবনাবসানের দীর্ঘ ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও তাঁর নামে নির্মাণ করা হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ব , কালের আবর্তে ডাকা পড়ে গেছে তিনির নাম। যে বীর গেরিলা ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে অস্ত্র হাতে পাক হানাদার বাহীনিকে পরাস্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন, সেই বীরের নামে সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় আজ কোথাও স্থাপন করা হয়নি কোনো নাম ফলক।

20

মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদিরের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৯৮-৯৯ ইং সালে তৎকালীন নৌ-ও পরিবহন মন্ত্রী আ স ম আব্দুর রবের নির্দেশে কদমতলী এলাকার ফেরিঘাট সড়ক থেকে জকিগঞ্জ সড়ক পর্যন্ত যে রাস্তাটি বিদ্যমান, সেই রাস্তাটি মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদিরের নামে সরকারীভাবে নামকরণ করে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প-৩ এর আওতায় রাস্তার কাজের টেন্ডার ইস্যু করা হয়। তখন থেকে এ সড়কটি  মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদিরের নামে সরকারী কাগজপত্রে বলবৎ থাকলে ও বাস্তবে রাস্তার কোথাও মুক্তাদিরের নামের অস্থিত্ব নেই। গ্রাম্য রাজনীতির হীন আক্রোশের শিকার হয়ে সেই সড়কটি মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদির সড়কের  বদলে শ্রী কৃষœ জাঙ্গাল সড়ক নাম ধারণ করে আছে। এ নিয়ে এলাকায় রয়েছে মতবেদ, যার ফলে আড়ালেই রয়ে গেছে  মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদিরের নাম। বর্তমানে স্থানীয় সচেতন মহলের দাবী  মুক্তিযোদ্ধা ম আ মুক্তাদিরের নামে কদমতলী পয়েন্টে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা চত্ত্বরটি মুক্তাদির চত্ত্বর নামে নামকরণ করা হোক।
21
একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান দেখানোর মধ্যদিয়ে নিজের দেশ ও জাতির প্রতিই সম্মান দেখানো হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদিরের প্রতি সম্মান দেখাতে আজ আমরা ও ব্যর্থ।  বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদির নেই, কিন্তু প্রয়াত হয়ে যায়নি তার চিন্তা, চেতনা, মেধার বিকাশ, আদর্শ ও কর্ম। তিনি যা রেখে গেছেন, আমরা যদি তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত হই, তাহলেই আমরা দাবী করতে পারব নিজেদের দেশ প্রেমিক হিসেবে। আর দেশ প্রেমিক হলেই আমরা এক বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে সমাজ বিপ্লবের গানে উচ্চকিত সৈনিক হিসেবে পথ চলতে পারব। আমাদের মত ও পথ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সবকিছুর শেষে তো আমরা চাই একটি সুশীল, প্রগতিশীল, অসম্প্রদায়িক সমাজ যার স্বপ্ন দেখতেন মুক্তাদির।

16
ম.আ. মুক্তাদির-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা থানার ঐতিহ্যবাহী কদমতলী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুুসলিম পরিবারে ১৯৫২ সালে মরহুম ম. আ. মুক্তাদির জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম মুসলিম মিয়া। ৫ ভাই ৪ বোনের মধ্যে তিনি ৫ম এবং ভাইদের মধ্যে ৪র্থ ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি প্রচন্ড ঝোক ছিল। স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে তিনি রাজা জি.সি. উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি একজন ভাল ফুটবলার ছিলেন। স্কুলের ছাত্র থাকাকালেই একজন ভাল ক্রীড়াবিদ ও মেধাবী ছাত্র হিসেবে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন।

18

কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতার একজন কিশোর কর্মী হিসেবে ‘৬৭ ও ৬৮’ সালে ‘দেশ ও কৃষ্টি’ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ‘৬৮ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। ‘৬৯ সালের মহান গণঅভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় সংগঠক। মদন মোহন কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে আই.এ পাস করেন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি তিনি যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বলিষ্ঠ সংগঠক মরহুম আখতার আহমদের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তৎকালীন মেজর সি. আর দত্তের নেতৃত্বে ৪নং সেক্টরে একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ এর জন্মলগ্নে ছাত্রলীগে যোগ দেন এবং জাসদ সংগঠনের বলিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে ১৯৭৩ সালে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন।

১৯৭৪ সালে তিনি এম.সি কলেজ থেকে বি.এ পরীক্ষা দেন। ১৯৭৬ সালের ৯ জুন জাসদ রাজনীতির চরম দুর্দিনে জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মনোনীত হন তিনি। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে তিনি দ্বিতীয় বার ছাত্রলীগ সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে বাসদ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি বাসদের কেন্দ্রীয় সদস্য ও জেলা বাসদের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্ব গ্রহণে তিনি কিছুদিন বাসদ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৮৫ সালে তিনি এক পুত্র (রাহাত) সন্তান লাভ করেন।
১৯৮৬ সালে তিনি লন্ডনে পাড়ি জমান। লন্ডনে তিনি প্রবাসী বাঙালিদের মাঝে বাসদকে সংগঠিত করেন এবং পরবর্তীকালে লন্ডনের লেবার পার্টিতে যোগ দেন। লন্ডনে তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত হন এবং সমাজকর্মী হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। তিনি লন্ডনে প্রবাসী সিলেটী ও বাঙালিদের ন্যায্য দাবী ও অধিকার আদায়ের জন্য একজন সক্রিয় সংগঠক ও নেতার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সিলেট বিভাগ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যুদ্ধাপরাধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি ঘোষিত আন্দোলনে প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠিত করেন এবং স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে লন্ডনে বলিষ্ঠ সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মঞ্চের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা। ১৯৯৫ সালে তাঁর স্ত্রী বেবীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ১৯৯৬ সালে তিনি পূণরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনির মৃত্যুর ১৬ দিন পূর্বে এক পুত্র সন্তান লাভ করেন। দুই পুত্র সন্তানের জনক মুক্তাদির ১৯৭৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত সিলেটের ফুটবল জগতে হোয়াইট মোহামেডানের একজন সক্রিয় খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি দক্ষিণ সুরমা ক্রীড়াচক্রেরও খেলোয়াড় ছিলেন।
ম. আ. মুক্তাদির ১৯৯৭ ইং সালের ১২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার লন্ডনে ‘বাংলা টাউন’ আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠার সমূহ জড়িত থেকে অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার সময় অসুস্থবোধ করেন। তাঁকে সাথে সাথে লন্ডন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় লন্ডন সময় ১৪ সেপ্টেম্বর রাত ১০ টায় হাসপাতালেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ২ পুত্র সন্তান, ভাই- বোন সহ অসংখ্য আত্মীয় স্বজন রেখে গেছেন। ম. আ. মুক্তাদিদের মরদেহ কদমতলীস্থ তাঁর পারিবারিক কবরস্থানে চিরশায়ীত করা হয়।
লেখক-এম এ মালেক,(তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক,সিলেট জেলা প্রেসক্লাব) তথ্যসূত্র- প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মুক্তাদিরের  পারিবার।