১৩ বছরে প্রাণ গেলো ৫৫ জনের
সিলেটের অন্যতম পর্যটন স্পষ্ট জাফলংয়ে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছে না। ১৬ দিনের ব্যবধানে সেখানকার পাহাড়ি নদী পিয়াইনে ডুবে মারা গেছে আরেক কিশোর। ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৩ বছরে জাফলংয়ে বেড়াতে এসে পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন নানা বয়সের ৫৫ জন। তাদের বেশির ভাগই কিশোর ও তরুণ। পাহাড়ি নদীর চোরাবালিতে পড়ে ও সাঁতার না জানার কারণেই তাদের মৃত্যু হয়েছে।
সিলেটের জাফলং অপরূপ সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। পাহাড়টিলা আর চা বাগানসংলগ্ন সীমান্ত ঘেঁষা জাফলং প্রকৃতিকন্যা নামেও পরিচিত। সিলেট নগরী থেকে ৫৯ কিলোমিটার দূরে জাফলংয়ের অবস্থান। গোয়াইনঘাট উপজেলার অধীন জাফলংয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই সেখানে আসেন নানা বয়সের দেশী-বিদেশী পর্যটক। তবে ঈদ ও অন্যান্য ছুটির সময় জাফলংয়ে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড় পরিলক্ষিত হয়। এখানে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে স্বচ্ছ জলরাশির পিয়াইন নদী। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে এ নদী থেকে পাথর উত্তোলনের ফলে সৃষ্ট গর্তে বালু জমে চোরাবালির সৃষ্ট হওয়ায় এবং স্বচ্ছ জলধারায় গভীরতা কম দেখা যাওয়ায় কেউ কেউ পানিতে গোসল করতে নেমে তলিয়ে যান। পরে তাদের লাশ পাওয়া যায়। ছোট নৌকায় ভ্রমণ করতে গিয়েও পিয়াইন নদীতে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ আগস্ট জাফলংয়ের পিয়াইন নদীতে ডুবে মারা যায় বেড়াতে আসা মো: আসিফ (১৭) নামে এক কিশোর। তার বাড়ি গাজীপুরের টঙ্গীর এরমাদপুর গ্রামে। তার বাবার নাম আব্দুর রহমান। স্কুলছাত্র আসিফ আত্মীয়স্বজনসহ ওই দিন জাফলং বেড়াতে আসে। বিকেলে পিকনিক সেন্টারের গাড়ি পার্কিংয়ের স্থানের পাশে পিয়াইন নদীতে পা পিছলে পড়ে যায়। এ সময় স্রোতে ভেসে গেলে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে পাওয়া যায়নি। ২১ আগস্ট দুপুরে নদীতে তার লাশ ভেসে উঠলে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। এর আগে গত ৩ আগস্ট জাফলংয়ের জিরো পয়েন্টে পিয়াইন নদীতে সাঁতার কাটতে গিয়ে প্রাণ হারায় সিলেট ব্লুবার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র আশফাক সিদ্দিকী। নিখোঁজ হওয়ার প্রায় তিন ঘণ্টা পর ওই এলাকা থেকে স্থানীয় জনসাধারণ তার লাশ উদ্ধার করেন। তিনি সিলেট নগরীর ঘাসিটুলা এলাকার মাহবুব সিদ্দিকীর ছেলে। এ ছাড়া গত বছরের ২২ জুলাই ঈদুল ফিতরের ছুটিতে পিয়াইন নদীতে গোসল করতে নেমে প্রাণ হারায় ঢাকার দুই কলেজ ছাত্র। আব্দুল্লাহ অন্তর (১৮) ও সোহাগ ঘোষ (১৭) নামে এই দুই তরুণ ঢাকার কবি নজরুল কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিল। সোহাগ ও অন্তরসহ ওই কলেজের ছয় ছাত্র জাফলং বেড়াতে এসেছিল। তারা ওই দিন বিকেলে জাফলংয়ের জিরো পয়েন্টে পিয়াইন নদীতে গোসল করতে নামে। এ সময় আবদুল্লাহ অন্তর ও সোহাগ ঘোষ স্রোতের টানে তলিয়ে যায়। এর দু’দিন পর একজন ও তিন দিন পর আরেকজনের লাশ পাওয়া যায়। এর আগের বছরও পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটিতে জাফলংয়ে পর্যটকদের ঢল নেমেছিল। সে সময় তিন দিনের ব্যবধানে নদীতে গোসল করতে নেমে ও নৌকাডুবিতে প্রাণ হারান শিশুসহ সাতজন। ওই বছরের ২ আগস্ট প্রাণ হারান নারায়ণগঞ্জের জসিম উদ্দিন। এরও আগে ৩১ জুলাই পিয়াইন নদীতে নৌকাডুবে মারা যান মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাকিল (১০), মামুন (২২) ও সাদেক হোসেন (২০)। একই দিনে চোরাবালিতে হারিয়ে যান সিলেটের শাহী ঈদগাহ হোসনাবাদ এলাকার কামরুল (২০) এবং সাঁতার কাটতে গিয়ে মারা যান অজ্ঞাত এক যুবক। ২০০৩ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এক দশকে পিয়াইন নদীতে ডুবে মারা গেছেন আরো ৩৮ জন। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকার শনিরআখড়া এলাকার শুভ আহমদ, ২৫ অক্টোবর ঢাকার যাত্রাবাড়ীর কলেজছাত্র ইমরান হোসেন এবং ৩০ মে মাদারীপুর সদর উপজেলার চলকিপুর গ্রামের মো: ইব্রাহীমসহ চারজন মারা যান। ২০১২ সালের ২২ আগস্ট ঢাকা জেলার ফাহাদ উদ্দিন, ৩০ আগস্ট মৌলভীবাজারের কুলাউড়া এলাকার হিমেল রাজ সঞ্জয়সহ মোট দুইজন মারা যান। ২০১০ সালের ২৩ মার্চ ঢাকার খিলগাঁও এলাকার তারেক আহমেদ, ২০ মে রফিকুল ইসলাম ও গৌরাঙ্গ কর্মকার, ২২ মে ঢাকার শাহরিয়ার আহমেদ রাব্বি, ২ জুলাই ঢাকার তেজগাঁও এলাকার শাহরিয়ার শফিক, ৩০ জুলাই জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ এলাকার মুস্তাকিন তালুকদার, ১২ সেপ্টেম্বর ঝালকাঠি জেলার রুহুল আমিন খান রুমিসহ সাতজন মারা যান। ২০০৯ সালের ২৬ জানুয়ারি হবিগঞ্জ বানিপুর এলাকার ইউনুছ মিয়া, ৮ মে ঢাকার মিরপুরের ফারুক আহমদ, ২১ জুন নরসিংদী সদর এলাকার সজিব মিয়াসহ তিনজন মারা যান। ২০০৮ সালের ৯ নভেম্বর ঢাকার পল্লবী এলাকার দিলশাদ আহমেদ ও ২০০৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি গোয়াইনঘাট উপজেলার মুসা মিয়া, ১৬ আগস্ট একই উপজেলার ফখরুল ইসলামসহ দুইজন মারা যান। ২০০৪ সালে ২ জন, ২০০৫ সালে একজন এবং ২০০৭ সালে ২ জন পর্যটকের মৃত্যু হয়। ২০০৩ সালের ১৫ আগস্ট জাফলংয়ে পিয়াইন নদীতে সলিলসমাধি ঘটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রেজাউর রহমান ফয়সাল ও রাজন আহমদের। –
সূত্র:নয়া-দিগন্ত