আমিনুল ইসলাম রোকন ::: ভূমিদস্যুতা নিয়ে বিশ্বখ্যাত লেখক তলস্তয়ের সারা জাগানো একটি গল্প আছে। ‘সাড়ে তিন হাত জমি’ নামে এই গল্পটি এখনও ভূমিখেকোদের পরিণতির এক জ্বলন্ত উদাহরণ। গল্পের নায়ক ফাহাম ছিলো নিতান্ত গরিব। তার এক প্রতিবেশি মহিলার বিপুল পরিমাণ জমির প্রতি তার লোভ জাগে। এক সময় নানা কূট-কৌশলে এই জমিটুকু তার আয়ত্বে নিয়ে আসে ফাহাম। মহিলার ওই জমি হজম করে বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে। দেদারছে মানুষের জমি আত্মসাৎ করতে থাকে। ফাহামের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন প্রতিবেশীরা। কিভাবে দমানো যায় এই চিন্তায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ওঠেন অনেকে। এক সময় এক পন্ডিত বের করেন সমাধান। ফাহামকে প্রস্তাব দেয়া হয় পাশেই একটি দেশ আছে। যেখানে বিনে পয়সায় অনেক জমির মালিক হওয়া যায়। শুধু শর্ত একটাইÑ যতটুকু জমি চাই দেয়া হবে, তবে তা নিতে হবে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দৌড়ে। এই সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যতদূর আগানো যাবে ততটুকু জমি নিজের করে নেয়া যাবে। লোভী ফাহাম সহজেই টোপটি গিলে নেয়। সে জমি নিতে পাড়ি দেয় ওই দেশে। রাজার সামনে উপস্থিত হয়ে জমি নেয়ার আবেদন জানায়। রাজা বললেন, ঠিক আছে। কাল সূর্যোদয় থেকে দৌড়ানো শুরু করো। লোভী ফাহাম রাজার প্রস্তাবে সারারাত আর ঘুমায়নি। এই তো সুযোগ। অত:পর সূর্যোদয়ের মুহূর্তে থেকে দৌড়াতে শুরু করে সে। ফাহাম দৌড়াচ্ছে। এদিকে সূর্যও তার তীক্ষè রশ্মি ছড়াচ্ছে সময়ে সময়ে। একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে ফাহাম। পানির জন্য হৃদয়ে তৃষ্ণা জাগে তার। কিন্তু হৃদয়ের লোভ তাকে থামতে দেয় না। থামলেই তো জমির পরিমাণ একটু কমে যাবে! ক্লান্ত অবস্থায়ও ফের দৌড় শুরু করে সে। এক সময় সমস্ত শরীরে ক্লান্তির ছাপ তাকে আর এগুতে দেয় না। পিছন ফিরে তাকায় সে। ইতোমধ্যে অনেক জমির মালিক হয়ে গেছে। আবার সামনের দিকে তাকায়। দৃষ্টিসীমানা জুড়ে শুধু জমি আর জমি। অতি লোভের কাছে হার মানায় ক্লান্তি। মধ্যপথে সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর দাঁড়িয়ে তখনও দমে না সে। সূর্যাস্ত পর্যন্ত দৌড়াতে হবে। তাহলেই তো দৃষ্টিসীমানা জুড়ে সবটুকু জমির মালিক হয়ে যাবে সে। ফাহাম দৌড়ায়। এক সময় ক্লান্ত অবসাদ শরীর আর চালাতে পারে না। পুরো পৃথিবীই যেনো সংকীর্ণ হয়ে আসে তার সামনে। মাটিতে লুটে পড়ে কাতরাতে থাকে লোভী ফাহাম। তৃষ্ণায় দমফাটা আর্তনাদ আসে তার। কিন্তু তখন আর আশেপাশে কেউ নেই। লোকালয় থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে সে। এখন তার চারপাশ ঘিরে শুধু জমি আর জমি। এক ফোটা জল দেয়ারও কেউ নেই তার সীমানা জুড়ে। এক সময় তৃষ্ণার্ত ফাহাম মরে যায় সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই। খবরটি যখন ছড়িয়ে পড়ে সবাই আসে রাজার কাছে। রাজা তখন বলে উঠেন, ‘এই জমিটুকুই প্রাপ্য ছিল তার। ফাহামের জন্য তার প্রাপ্য সাড়ে তিন হাত কবরের জমি দিয়ে দাও।’ রাগীব আলীও দৌড়াচ্ছেন। সিলেটজুড়ে তার আছে বিস্তৃত জমি। আরও জমি চাই রাগীব আলীর। অনেক আগে কূট-কৌশলে নিয়ে যাওয়া তারাপুর সম্প্রতি হারিয়েছেন তিনি। জমিটুকু হারিয়ে গল্পের সেই ফাহামের মতোই অবস্থা হয়েছে তার। জমি ফিরে পেতে দৌড় শুরু করেছেন তিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় সিলেট তথা সারা দেশের প্রভাবশালী এই ব্যক্তিত্ব। মামলায় হেরে দিশেহারাও তিনি। তারাপুর বহাল রাখতে ২০০৯ সালে ছেলে আব্দুল হাইয়ের করা মামলায় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারকের বেঞ্চ গত ১৯ জানুযারি রায় দেন। এ রায়ে আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে রাগীব আলীর মাথায়। স্থাপনা সরানোর নির্দেশেরও অন্তিম সময় চলছে। ৬ মাসের এই মেয়াদ শেষ হবে আগামী মাসে। মেয়াদ শেষ হতে চললেও এখনো কোনো স্থপনা সরাননি রাগীব আলী। সেবায়েত পঙ্কজকেও এখনো কোন কাগজ সমঝে দেননি। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, এখনো উচ্চ আদালতে দৌড়াচ্ছেন তিনি। সর্বশেষ তারাপুর থেকে রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ যাতে না সরানো হয় তা নিয়ে হাইকোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করেছেন তিনি। রাগীব আলীর জন্ম ১৯৩৮ সালের ১০ অক্টোবর। তাঁর বাবা রাশীদ আলী ছিলেন মরমী কবি দেওয়ান হাছন রাজার সহকারী। হাছন রাজার জমিদারী দেখাশোনা এমনকি দলিল লেখকের দায়িত্বে ছিলেন বলে সিলেটের ইতিহাসের বিভিন্ন বইয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়। সামান্য দলিল লেখকের ছেলে কিভাবে সারা দেশজুড়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুললেন তা রীতিমত এক রহস্য। নানা কূট-কৌশলে তিনি সিলেটের একের পর এক চা বাগান দখল করে নেন। তারাপুরের আগে কানাইঘাটের লোভাছাড়া বাগানটিও দখলের চেষ্টা করেন রাগীব আলী। এই বাগানটি বেশ কিছুদিন তাঁর দখলেও ছিলো। পরে বাগানের আসল মালিক বৃটিশ বংশদূত ফারনান্দেজ নানকা স্থানীয় এলাকাবাসীর সহায়তায় রাগীব আলীকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেন। একসময়ে নানা কূট-কৌশলে দখল করা কোটি কোটি টাকার সম্পদ সাম্প্রতিক সময়ে এসে হুট করে হাতছাড়া হতে থাকে রাগীব আলীর। তারাপুর চা বাগানের মামলায় হারার ঠিক আগ মুহূর্তে আলোচিত অরেকটি মামলার রায় যায় তার বিরুদ্ধে। রাগীব আলীর পিতৃভূমি তালেবপুরের ইতিহাসও সবার জানা। গতবছর শেষের দিকে তালেবপুরের মামলায়ও হেরে যান তিনি। কৌশলী রাগীব আলী তার নিজের গ্রাম তালেবপুরের নাম পরিবর্তন করে নিজের নামে ‘রাগীব নগর’ নামকরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিধিবাম, সে আশাও পূর্ণ হয়নি তাঁর। আদালতের রায়ে গ্রামের নাম তালেবপুরই থেকে যায়। রাগীব আলীর সম্পদের উৎস নিয়ে জনমনে রয়েছে নানা প্রশ্ন। সিলেটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তার সম্পত্তির পরিমাণ নিয়েও রয়েছে নানা হিসাব-নিকাশ। দুই হাজার কোটি টাকা মূল্যের দেবোত্তর সম্পত্তি তারাপুর চা বাগান প্রতারণার মাধ্যমে লিজ নেন তিনি। লিজের শর্ত ভঙ্গ করে চা বাগান ধ্বংস করে গড়ে তুলেন হাউজিং প্রকল্প ও নানা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাগানটিতে নিজ নামে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও গড়ে তুলেন। চা বাগান দখলের ঘটনায় গঠিত সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদন ও প্রতারণা মামলার এজাহারে তারাপুর চা বাগান নিয়ে রাগীব আলীর নানা জালিয়াতির চিত্র প্রকাশ পায়। রাগীব আলীর এমন গল্প এখন মানুষের মূখে মূখে। সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনায় উত্তপ্ত দেশ। ঘটনার আড়ালে চাপা পড়ছে ঘটনা। কিন্তু সিলেটে রাগীব আলী আছেন শীর্ষে। রাগীব আলীর ভাগ্যের সাথে দোল খাচ্ছে তারাপুরের কয়েক শ’ পরিবারেরও ভাগ্য। অনেক কষ্টে জীবনের পুরো অর্জন দিয়ে তারপুরে বাড়ি কিনেছেন অনেকে। কিন্তু আদালতের আদেশে তাদের কপালেও চিন্তার ভাজ। হতাশায় ডুবছেন তারা। এলাকাবাসীর অভিযোগ অনেকেই রাগীব আলীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। ফেরত চাচ্ছেন তাদের টাকা। কিন্তু কোনো সুরাহা পাচ্ছেন না। কি হবে এমন ভাবনায় দুঃস্বপ্নের দিন কাটছে তাদের। রাগীব অলী রয়েছেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।